মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মার্কিন রাজনীতির ‘নিয়ন্ত্রক’ ইহুদি লবিং আইপ্যাক

সৈয়দ মুহাম্মদ আজম

প্রকাশিত: এপ্রিল ৮, ২০২৫, ০৯:২৪ পিএম

মার্কিন রাজনীতির ‘নিয়ন্ত্রক’ ইহুদি লবিং আইপ্যাক

ছবি : রূপালী বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ককে বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল কূটনৈতিক সম্পর্ক বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রভাব সৃষ্টির জন্য ইসরায়েল যেমন প্রচুর অর্থ ব্যয় করে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রও তাদের বড় অঙ্কের আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে।

অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে তার কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি দিয়েছে। এর প্রতিদান অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রও কম দিচ্ছে না! আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করে মূলত কর্পোরেট হাউজগুলো। তারা প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত বানাতে পারে, সরাতে পারে।

এসব কর্পোরেট হাউজগুলোর মালিক কিংবা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হলেন জুইশ কমিউনিটির মানুষ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পেছনে রয়েছে শক্তিশালী ‘ইহুদি লবিং’ আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (আইপ্যাক)। ভূ-রাজনৈতিকদের অনেকেই মনে করেন, আইপ্যাকই মার্কিন রাজনীতির ‘নিয়ন্ত্রক’।

আইপ্যাক কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। কিন্তু এরপরও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণে এর বড় প্রভাব রয়েছে। মার্কিন সরকারের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিভিন্ন সিদ্ধান্তে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে থাকে। যেমন- ফিলিস্তিনে বর্বর গণহত্যা সত্ত্বেও ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন।

মার্কিন কংগ্রেসে সদস্যদের ৯০ শতাংশের বেশি ইসরায়েলপন্থী অবস্থান নেয়। কারণ ইসরায়েলি লবি তাদের সমর্থন করে। তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কথা বলে নিজেদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ঝুঁকিতে ফেলতে চান না।

১৯৫৩ সালের পশ্চিম তীরের কিবিয়া গ্রামে হামলা করে কয়েক ডজন ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুকে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী। এ ঘটনার পর রাজনৈতিক চাপ সামাল দিতে ইসরায়েল সরকারের একজন লবিস্ট এ সংগঠন প্রতিষ্টা করেন। ১৯৫৯ সালে এর নামকরণ করা হয় আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (আইপ্যাক)।

১৯৭৩ সালে ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধ শেষে বিরাট আর্থিক সহায়তা পাওয়ার পর শক্তিশালী লস্টি গোষ্ঠীতে পরিণত আমেরিকান জায়োনিস্ট এই কমিটি। যদিও তেলআবিবের সংবাদপত্র হারেৎজ আইপ্যাককে ‘নেতানিয়াহুপন্থী ইসরায়েল-বিরোধী লবি’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।

‘কংগ্রেশনাল ক্লাব’ নামে আইপ্যাকের বিশেষ একটি দল আছে। এই দলের প্রত্যেক সদস্য প্রতি মার্কিন নির্বাচনে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার ডলার চাঁদা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর এই অর্থ ইসরায়েলপন্থী রাজনীতিবিদদের নির্বাচনে ব্যয় করা হয়। পরবর্তীতে এদের মধ্যে যারা জয়লাভ করে, তাদের মাধ্যমে সিনেট এবং হাউজে প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের নীতির বাস্তবায়ন করে।

তবে আইপ্যাক সামগ্রিকভাবে কত অর্থ ব্যয় করে, সেসম্পর্কে কোনো তথ্য জানা যায় না। তাদের এমন কিছু সদস্য আছে, যারা এক মিলিয়ন থেকে শত মিলিয়ন পর্যন্ত অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। আর এই সকল দাতাদের ধ্যান-ধারণা সবই ইসরায়েলকে ঘিরে। তারা যেকোনো মূল্যে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে টিকিয়ে রাখতে চান।

শুধুমাত্র ট্রাম্পের শাসনামলেই আইপ্যাক অনেকগুলো সফলতা অর্জন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা, ইরানের সাথে করা পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে আসা, ফিলিস্তিনকে দেওয়া সাহায্য বন্ধ করা এবং সম্প্রতি অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপন করা।

যুক্তরাষ্ট্রে এমন অনেক সংগঠন রয়েছে, যারা ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন তৈরিতে কাজ করে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন হচ্ছে এআইপিএসি বা আইপ্যাক। এই সংগঠনের সদস্যদের প্রভাব মার্কিন ইহুদিদের মধ্যে একেবারে তৃণমূলেও রয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন ইহুদিদের নানা পরামর্শ দিয়ে থাকে, তাদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করে থাকে। শুধু ইহুদি নয়, কট্টরপন্থী খ্রিষ্টান ইভানজেলিক গির্জা থেকেও তারা তহবিল সংগ্রহ করে।

আইপ্যাক প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বার্ষিক সম্মেলন করে থাকে। এতে প্রায় ২০ হাজার প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন, যাদের মধ্যে মার্কিন রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে নেতারা রয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। তারা দুজনেই আত্মস্বীকৃত ইহুদিবাদী। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিয়মিত এই সম্মেলনে হাজির হন।

এখন কথা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে এআইপিএসি বা আইপ্যাকের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন আছে? তাদের মতো প্রভাবশালী না হলেও ইসরায়েলপন্থী ‘জে স্ট্রিট’ নামে একটি ছোট সংগঠন রয়েছে। ডেমোক্র্যাটরা মূলত এই সংগঠন তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। এদের লক্ষ্য, মার্কিন রাজনীতিতে একটি সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করা, যারা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রতি সোচ্চার হবে।

ইসরায়েলপন্থী বিভিন্ন গ্রুপ মার্কিন রাজনীতিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে থাকে। ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৩০ বিলিয়ন ডলার তহবিল দিয়েছে আইপ্যাক। এর মধ্যে ১১ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে ডেমোক্র্যাটরা এবং ১৯ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে রিপাবলিকানরা। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনি প্রচারে ইসরায়েলপন্থী গ্রুপগুলো ৩ কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার তহবিল দিয়েছে, যার ৬৩ শতাংশ পেয়েছেন ডেমোক্র্যাটরা, ৩৬ শতাংশ পেয়েছেন রিপাবলিকানরা।

২০১৬ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে আইপ্যাকের বাৎষরিক পলিসি সভায় বক্তব্য দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি : এপি  

ওপেনসিক্রেট-এর তথ্যমতে, ২০১৬ সালের তুলনায় ওই বছর প্রায় দ্বিগুণ নির্বাচনী তহবিলের জোগান দিয়েছে ইসরায়েলপন্থী গ্রুপগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ইসরায়েলের প্রভাব কতটা, সেটা ওপরের লেখা থেকে কিছুটা হলেও আঁচ করা যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান মার্কিন রাজনীতিকদের মধ্যে কার প্রতি ইসরায়েলের সমর্থন বেশি।

বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি ইসরায়েলের অগাধ সমর্থন রয়েছে। তিনি ইসরায়েলকে সমর্থন করেন বলে ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরা তাকে সমর্থন করেন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুরও তার প্রতি সমর্থন রয়েছে। চার বছরের ক্ষমতার মেয়াদে ট্রাম্প ইসরায়েলের ঘোর সমর্থক ছিলেন। পরবর্তী মেয়াদে জো বাইডেনের সঙ্গে নেতানিয়াহুর সম্পর্কে টানাপোড়েন স্পষ্টতই দেখা গেছে। এবং পুনরায় হোয়াইট হাউসে ফিরেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

মার্কিন কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান পার্টির বেশির ভাগ সদস্য প্রকাশ্যেই ইসরায়েলকে সমর্থন করে থাকেন। প্রতিনিধি পরিষদের ডেমোক্র্যাট–দলীয় সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি, সাবেক স্পিকার জন ম্যাকার্থি, সিনেটর চাক শুমার থেকে শুরু করে বেশির ভাগ সদস্যই ইসরায়েলের পক্ষে। এই নামের তালিকা করতে গেলে বোধ করি খুব কমই বাদ যাবেন। তারা বর্তমান সংঘাতে ইসরায়েলের পক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলছেন এবং হামাসকে নির্মূল করার পক্ষে জোরালো বক্তব্য দিচ্ছেন।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে আইপ্যাক একটি সুপার পাওয়ার পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি গঠন করে। যার নাম দেওয়া হয় ইউনাইটেড ডেমোক্রেসি প্রজেক্ট (ইউডিপি)। এটি ব্যক্তিগত রাজনৈতিক প্রচারণায় পক্ষে-বিপক্ষে অঢেল অর্থ ব্যয় করার অধিকার রাখে। আর ইউডিপিতে প্রধান অর্থ দাতাদের মধ্যে রয়েছেন হোয়াটসঅ্যাপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জ্যান কুম, জোনাথন জ্যাকবসন, ইসরায়েলি বংশোদ্ভূত উদ্যোক্তা ডেভিড জালিক, হোম ডিপোর প্রতিষ্ঠাতা বার্নি মার্কাস, হেজ ফান্ড ম্যানেজার পল সিঙ্গার।

একই লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট গোষ্ঠীর সৃষ্টি করা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রধানতম হলো ডেমোক্র্যাটিক মেজরিটি ফর ইসরায়েল (ডিএমএফআই)। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একজন ডেমোক্র্যাটিক রাজনৈতিক উপদেষ্টা মার্ক মেলম্যান ডিএমএফআই প্রতিষ্ঠা করেন। ডিএমএফআই’র পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন জিউবিলংয়ের আর্চি গোটেসম্যান। এর শীর্ষ অর্থ দাতাদের মধ্যে রয়েছেন চলচ্চিত্র প্রযোজক মেল সাইমনের কন্যা ডেবোরা সাইমন। তিনি অ্যান্টি-ডেফামেশন লীগের মতো ইহুদি সংগঠনগুলোকেও নিয়মিত অনুদান দেন।

এছাড়াও রয়েছেন জালিয়াতির অভিযোগে ২৫ বছর কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক ক্রিপ্টোকারেন্সি বিলিয়নিয়ার স্যাম ব্যাংকম্যান-ফ্রাইড। ডিএমএফআইয়ের অন্যান্য প্রধান অর্থ দাতাদের সাথে আাইপ্যাকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যেমন- স্ট্যাসি শুস্টারম্যান এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট গ্যারি লডার।

২০১৬ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইসরায়েলের সঙ্গে ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তিতে সই করেন। ওই চুক্তির আওতায় পরবর্তী ১০ বছর মার্কিন সামরিক সহায়তা পাবে ইসরায়েল। এর মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আয়রন ডোমের তহবিলও রয়েছে। সে বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে ইসরায়েল। তবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরে হামাসের হামলার পর গাজায় ইসরায়েলি আক্রমণে বেসামরিক ফিলিস্তিনির মৃত্যুর সংখ্যার বাড়ায় আইপ্যাককে সরাসরি দেওয়া মিলিয়ন ডলারের চুক্তি থেকে সরে আসে ইউডিপি।

প্রকৃতপক্ষে, খুব একটা সহায়তার দরকার হয় না ইসরায়েলের। কারণ, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি খাত থেকে তাদের বিপুল পরিমাণ আয় রয়েছে, যা ইসরায়েলকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করেছে। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি, জনমত, অর্থ ও রাজনীতি- এসব বিষয়ও ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতে মার্কিন নীতিতে বিরাট প্রভাব রাখে।

আরবি/এসএমএ

Link copied!