‘মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া’ খ্যাত ইসরায়েল এশিয়ার একটি ছোট দেশ। আকারে ছোট হলেও দেশটির শক্তি এবং ক্ষমতা বিশ্বের অনেক শক্তিশালী দেশের সাথে তুলনীয়।
লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি, সিরিয়ান ও লেবানিজ বেসামরিক নাগরিকদের নির্মমভাবে হত্যা, নির্যাতন এবং বাস্তুহীন করার দায়ে অভিযুক্ত আগ্রাসী এ দেশের বিরুদ্ধে অনেক দেশকেই প্রতিবাদমুখর থাকতে দেখা যায়।
কিন্তু, বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর পাশাপাশি কোনো আরব রাষ্ট্রকেও দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে কিংবা সামরিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেখা যায়না।
ইসরায়েলের এই রহস্যময় শক্তির পেছনে অনেকগুলো কারণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছে।
এই শক্তির মূল কারণগুলো কেবলমাত্র সামরিক শক্তি বা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে নয়, বরং একাধিক কারণের সমন্বয়ে ইসরায়েল এক বিশেষ অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, যা তাকে দিনদিন অপ্রতিরোধ্য করে তুলছে।
চলুন বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক, ইসরায়েল কেন এত শক্তিশালী এবং কীভাবে বিশ্বব্যাপী এত প্রভাব তৈরি করলো দেশটি।
সামরিক শক্তি
ইসরায়েল তার সামরিক শক্তির জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত। দেশটি প্রতি বছর তার বাজেটের একটি বড় অংশ সামরিক খাতে ব্যয় করে। বিশ্বের অন্যতম উন্নত ও আধুনিক সেনাবাহিনী তৈরি করেছে দেশটি।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)-কে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সেনাবাহিনী হিসেবে গণ্য হয়। সামরিক শক্তিতে বিশ্বের শীর্ষ ২০- এর মাঝেই দেশটির অবস্থান।
প্রতিরক্ষা খাতে তাদের রয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, সাইবার যুদ্ধ ক্ষমতা, এবং উন্নত বিমান বাহিনী। তারা স্বয়ংক্রিয় যুদ্ধ যন্ত্রপাতি, ড্রোন, এবং অত্যাধুনিক মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার (যেমন: আয়রন ডোম) জন্য বিখ্যাত।
শুধু তাই নয়, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা এবং উন্নয়ন (R&D) খাতে ব্যাপক বিনিয়োগের কারণে ইসরায়েল প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ থেকে অনেক এগিয়ে আছে।
পারমাণবিক শক্তি
ইসরায়েল একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে পরিচিত। যদিও তারা আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্রের মালিকানা স্বীকার করে না।
তবে, আন্তর্জাতিক পরমাণু বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরায়েল অন্তত ২০০টিরও বেশি পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক। এটি তাদের কৌশলগত নিরাপত্তা এবং সামরিক শক্তি বাড়ানোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
এই শক্তিই ইসরায়েলকে যুদ্ধের ক্ষেত্রে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। একইসাথে, এটি ইসরায়েলের প্রতি প্রতিপক্ষদের ভয় এবং শ্রদ্ধার বড় কারণ।
বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে অগ্রগতি
ইসরায়েল শিক্ষা এবং গবেষণা খাতে বিশ্বমানের অগ্রগতি লাভ করেছে। এ দেশের বৈজ্ঞানিক গবেষণা, উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভূমিকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত।
ইসরায়েল বিশ্বের অন্যতম বড় স্টার্টআপ হাব (স্টার্টআপ নেশন) হিসেবে পরিচিত। উন্নত প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন এবং বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর উপস্থিতি দেশটির প্রযুক্তি খাতে বিপ্লব নিয়ে এসেছে।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে সাইবার নিরাপত্তা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, এবং অত্যাধুনিক কৃষি প্রযুক্তি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং কূটনীতি
ইসরায়েল তার আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলো অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে গড়ে ওঠা শক্তিশালী সম্পর্ক, ইসরায়েলকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
এই সম্পর্কের মাধ্যমেই মানবতাবিরোধী সকল অপরাধ সংঘটন ও বিশ্ব শান্তি বিনষ্টকারী দেশ হয়েও আন্তর্জাতিক মঞ্চে সমর্থন পেয়ে যায় তারা । এমনকি, অনেক সংকটের সময়ে রাজনৈতিকভাবে এবং সামরিকভাবে স্বীকৃতি পেয়ে থাকে।
ইসরায়েল এর পাশাপাশি অন্যান্য অনেক দেশ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থির দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে, যার মাধ্যমে তাদের অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য বজায় থাকে।
অর্থনৈতিক শক্তি
ইসরায়েলের অর্থনীতি প্রযুক্তি, কৃষি, এবং অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে অনেক শক্তিশালী হয়েছে। উন্নত বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে ইসরায়েলের ব্যবসায়িক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তারা বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং অস্ত্র বিক্রি করে। আর আই অস্ত্র বিক্রি দেশটির আয়ের অন্যতম বড় উৎস।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
ইসরায়েলের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তার শক্তির আরেকটি মূল উপাদান। ইসরায়েলের জনগণ অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ এবং জাতীয়তাবাদী। ফলে দেশের প্রতি তাদের দৃঢ় আস্থা এবং আনুগত্য রয়েছে।
দেশটি কখনো কখনো রাজনৈতিক অস্থিরতার সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু তাদের সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সেসব মোকাবিলা করেছে।
ইসরায়েল সফলভাবে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম এবং দেশের রাজনীতি যথেষ্ট সংগঠিত এবং স্থিতিশীল।
কৌশলগত অবস্থান
ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে ইসরায়েল। এটি মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান শক্তির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।
অবস্থানগত কারণে এটি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এই অবস্থানই তাদের যুদ্ধের সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে এবং কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক সুবিধা করে দিয়েছে।
ইতোমধ্যেই ইসরায়েল তার সামরিক শক্তি, পারমাণবিক ক্ষমতা, প্রযুক্তি, এবং কূটনৈতিক দক্ষতার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তবে, এ শক্তি এবং ক্ষমতার পিছনে রয়েছে মার্কিনী ও পশ্চিমাদের অকাট্য সমর্থন, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, অদম্য আত্মবিশ্বাস এবং দেশের প্রতি জনগণের গভীর আস্থা।
ইসরায়েল তার প্রতিপক্ষের জন্য শুধুমাত্র এক শক্তিশালী সামরিক প্রতিপক্ষ নয়, বরং তারা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক ভীতি তৈরি করা একটি রাজনৈতিক এবং কৌশলগত শক্তি।
গোয়েন্দা সংস্থা
তিনটি গোয়েন্দা সংস্থা ইসরায়েলের নিরাপত্তা এবং স্বার্থ রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এর মাঝে অন্যতম ইসরায়েলের গোপন গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’।
এটি দেশের নিরাপত্তা এবং বিশ্বব্যাপী কুখ্যাত সব গোয়েন্দা কার্যক্রমের জন্য বহুল পরিচিত। এ সংস্থাকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী এবং পেশাদার গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে ধরা হয়।
ইসরায়েলের বাইরে গুপ্তচরবৃত্তি, শত্রুদের বিরুদ্ধে অপারেশন, এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের কাজে জড়িত থাকে মোসাদ। এটি বিশেষভাবে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং শত্রু রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে কার্যক্রম পরিচালনা করে।
সংস্থাটি মূলত খুব দ্রুত এবং সফলভাবে তথ্য সংগ্রহ এবং অপারেশন সম্পাদন করার জন্য বিখ্যাত।
অন্য আরেকটি গোয়েন্দা সংস্থা ‘শিন বেট’ ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা, যা দেশের নিরাপত্তা এবং অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে কাজ করে।
এটি সাধারণত ফিলিস্তিন অঞ্চলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কার্যক্রম ও অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণে জড়িত থাকে।
এছাড়াও, ‘আমান’ হলো ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, যা ইসরায়েল সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে কাজ করে। এটি মূলত যুদ্ধের পূর্বাভাস, শত্রুদের চলাফেরা পর্যবেক্ষণ এবং কৌশলগত সামরিক তথ্য সংগ্রহের কাজ করে।
মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগত জোট গঠন
অতীতে ইসরায়েল তার প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধের মুখোমুখি হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা প্রভাবশালী কিছু আরব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালে একটি চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল বাহরাইন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এটিকে ইসরায়েলের কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এই ধরনের কৌশলগত জোট পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই ইসরায়েলের সামরিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব বাড়িয়ে দিয়েছে।
সবকিছু বিবেচনায় এ কথা সহজেই অনুমেয়, ইসরায়েলের শক্তির উৎস কেবল সামরিক ক্ষমতা, প্রযুক্তি বা অর্থনৈতিক সফলতা নয় বরং এটি এক বিশাল কৌশলগত পরিকল্পনা এবং পশ্চিমাদের নিরঙ্কুশ সহযোগিতার একটি মেলবন্ধন।
আর এভাবেই বিশ্বে অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র হয়ে উঠছে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েল।
আপনার মতামত লিখুন :