ফিলিস্তিনে গণহত্যায় ইসরায়েলকে সহায়তা দিয়েছে যাচ্ছে বড় বড় টেক জায়ান্টরা। এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসরায়েলের বর্বরতার বিরুদ্ধে কথা বলতেও ‘বাধা’ দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু নাম বা শব্দ ‘ভায়োলেন্স’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে মেটা। এ নিয়ে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এক্সে ক্ষোভ ঝারতে দেখা গেছে নেটিজেনদের। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর এ অভিযোগ বহুদিনের।
সম্প্রতি মাইক্রোসফটের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিল গেটসের সামনেই অনুষ্ঠানের মধ্যে বাধা দেন ফিলিস্তিনপন্থী কর্মীরা। তারা অভিযোগ করেন, গাজায় গণহত্যা চালাতে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি সরবরাহ করছে মাইক্রোসফট। অর্ধলাখ ফিলিস্তিনি হত্যার জন্য মাইক্রোসফটকে দায়ী করেন তারা। জানা যায়, ফিলিস্তিনের পক্ষে প্রতিবাদকারী একজন কর্মী প্রতিষ্ঠানটি থেকে চাকরি ছেড়েছেন।
ফেসবুকের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি নির্যাতন-নিপীড়নের খবর প্রচার করা অ্যাকাউন্ট ও পোস্ট সরিয়ে ফেলার অভিযোগ বহু পুরোনো। এর প্রতিবাদও হয়ে আসছে অনেক দিন ধরে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) জানায়, গাজায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হলেও কাউকে তাদের পক্ষে কথা বলতে দিচ্ছে না ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম। মালিক প্রতিষ্ঠান মেটা সিস্টেমেটিক্যালি ফিলিস্তিনের পক্ষের কণ্ঠস্বরকে ‘থামিয়ে বা নীরব’ করে দিচ্ছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, গাজার সংঘাত নিয়ে ফিলিস্তিনি গণমাধ্যমগুলোর খবর দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকদের কাছে ঠিকমতো পৌঁছতে দিচ্ছে না ফেসবুক। সংবাদমাধ্যমটি ফেসবুকের তথ্য-উপাত্তগুলো ব্যাপকভাবে বিশ্লেষণ করেছে। তাতে দেখা গেছে, মেটার মালিকানাধীন আরেক সামাজিক মাধ্যম ইনস্টাগ্রাম ২০২৩ সালের অক্টোবরের পর থেকে ফিলিস্তিন সংক্রান্ত মন্তব্যগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে।
এমনকি গাজায় বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার খুবই সীমিত করেছে দখলদার ইসরায়েল। ফলে উপত্যকাটির নির্মম খবরগুলোর জন্য ভরসা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। প্যালেস্টাইন টিভি, ওয়াফা নিউজ এজেন্সি ও আল-ওয়াতান নিউজের মতো সংবাদমাধ্যমগুলোর ফেসবুক পেজ সংবাদসূত্র হয়ে উঠেছে। তবে ভয়াবহ খবর হলো- এসব পেজের ফলোয়ারদের তথ্য-উপাত্তগুলো হাতিয়ে নিচ্ছে ইসরায়েল। এজন্য আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করছে ইসরায়েল। আর তাদের এআই প্রযুক্তি সরবরাহ করছে মাইক্রোসফটের মতো টেক জায়ান্টরা।
ফিলিস্তিনিদের মারার জন্য ইসরায়েল ল্যাভেন্ডার নামক এআই সিস্টেমের ব্যবহার করছে বলে দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়। লক্ষ্যবস্তু সনাক্তে মেশিন-লার্নিং সিস্টেম ব্যবহার করে আসছে ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এআই দিয়ে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, গুগল, গুগলম্যাপ, হোয়াটসঅ্যাপ, ক্রোম ব্রাউজারে এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারকারীর স্পর্শকাতর সব তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এরপর চলে নজরদারি। এবং ইসরায়েলি বিরোধী প্রচারণায় ব্যান করা হয় আইডি, পেজ, অ্যাকাউন্ট। প্রাপ্ত তথ্য দিয়ে এআই সিস্টেমে সনাক্ত করা হয় লক্ষ্যবস্তু।
প্যালেস্টাইন টিভির সাংবাদিক তারিক জিয়াদ বলেন, ‘মিথস্ক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় আছে এবং মানুষের কাছে আমাদের পোস্টগুলো পৌঁছানো বন্ধ হয়ে গেছে।’ একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্ট কতটা প্রভাব ফেলছে ও কতজন লোক এর বিষয়বস্তু দেখছেন, তার একটি মূল পরিমাপক এনগেজমেন্ট বা সম্পৃক্ততা। যুদ্ধকালে অডিয়েন্স এনগেজমেন্ট বা শ্রোতা-পাঠক সম্পৃক্ততা বাড়বে বলে ধারণা করা হয়। অথচ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর ফিলিস্তিনি সংবাদমাধ্যমের পাঠক সম্পৃক্ততা ৭৭ শতাংশ কমেছে।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মাসুক সরকার বাতিস্তা বলেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) সিস্টেমের প্রধান শক্তি হচ্ছে ডেটা। সিস্টেম বা মডেলগুলোকে যত ডাটা দিয়ে ট্রেইন করা যাবে মডেলগুলো তত নির্ভুল ফিটব্যাক দিতে পারবে। এখন কোন মডেলকে কি কাজের জন্য ট্রেইন করা হবে সেটা নির্ভর করে মডেলটি কি কাজে ব্যবহার হবে তার উপর।
আমাদের ব্যক্তিগত ডেটা কীভাবে ফ্রিতে দিয়ে ফেলি- এ বিষয়ে তিনি বলেন, আপনি গুগলম্যাপ ব্যবহার করেন মানে আপনার অবস্থান গুগল জানে, তারা এগুলো স্টোর করছে। ফেসবুক দেখবেন আপনার কন্টাক্ট লিস্ট আপলোডের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। এতে আপনাকে নাম্বার দিয়ে ট্র্যাক করা কোন ব্যাপারই না। সাথে আপনার লিস্টে যারা আছে কে আপনার কি হয় জানা সহজ। যেমন ধরেন মা, বাবা, বড় ভাই দিয়ে সেইভ করা নামের সাথে এসাইন করা নাম্বার!
‘আরও ধরেন ক্রোম ব্রাউজার আপনার গুরুত্বপূর্ণ পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করছে, মেইল আইডি পাসওয়ার্ডসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ওয়েব সাইটের ব্রাউজিং হিস্ট্রি। ফেসবুকে যে পারিবারিক ছবি আপলোড দেন প্রত্যেকটা আপনার তথ্য! যেগুলো ব্যবহার করে আপনার পরিবারকেসহ সমূলে উৎপাটন সম্ভব। যদি কখনো যুদ্ধ লাগে আপনার দেয়া তথ্যগুলোই আপনার বড় দুর্বলতা হবে!’
এজন্য ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, গুগল, গুগল ম্যাপ, ক্রোম ব্রাউজারের বিকল্প তৈরির দিকে আলোকপাত করেন তিনি। উদাহরণ হিসেবে চীনের কথাও উল্লেখ করেছেন এই প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ।
আপনার মতামত লিখুন :