সেই ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী ফিলিস্তিনজুড়ে একের পর এক হামলা চালিয়েই যাচ্ছে। আর এই হামলার ফলে প্রতিদিন গড়ে শতাধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।
চুক্তি ভঙ্গ করে ইসরায়েলি দখলদাররা বারবার অসহায় গাজাবাসীর উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ যেন এখন সাধারণভাবে দেখছে পুরো বিশ্বায়ন। যাদের উপর আশা ছিল পাশে দাঁড়াবে, সেই আরবরাও এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের নিয়ে কোনো কড়া জবাব দেয়নি ইসরায়েলির বিরুদ্ধে।
এমন অসহনীয় মুহূর্তে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে তাহলে ফিলিস্তিনের ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি কোথায়? তাদের নিজেদের সেনাবাহিনী কোথায়? তারা কেন দেশরক্ষায় কাজ করছে না?
এবিপি এক প্রতিবেদনে বলেছিল, পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশের সেনাবাহিনী নেই, ফিলিস্তিন তার অন্যতম। ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কারণেই দেশটি কোনো সেনাবাহিনী গড়তে পারেনি।
অতীতে ফিলিস্তিনের সামরিক বাহিনী হিসেবে পরিচিতি ছিল প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন বা পিএলওর অধীনে থাকা প্যালেস্টাইন লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ। কিন্তু ১৯৯৩ সালে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে যে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সে সংগঠন ভেঙে দেওয়া হয়। আর ফিলিস্তিনকে করে দেওয়া হয় নিরস্ত্র একটি দেশ।
বর্তমানে ইসরায়েলি হামলা প্রতিরোধ করছে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। তবে তাদের এই সামরিক শাখা সরকার-স্বীকৃত নয়। তারপরও দেশ বাঁচাতে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে বলে দাবি করছে হামাস ও তার বেশ কিছু সহযোগী সংগঠন।
ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত একটি শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। আর তাতে থাকা শর্তগুলোর কারণেই ফিলিস্তিনের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী নেই আজকের এই বিশ্বে। ওই চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ফিলিস্তিনে কোনো সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠলে সেখানকার সরকার সে বাহিনীকে ইসরায়েলের হাতে তুলে দেবে। অন্যথায় ইসরায়েল ফিলিস্তিনে হামলা চালাবে।
ওই চুক্তিতে বলা হয়, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার স্বার্থে তারা আধা সামরিক বাহিনী গঠন করতে পারবে, কিন্তু এর পরিসীমাও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এই বাহিনীর বিস্তৃতি, অস্ত্র, ক্ষমতাসহ সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসরায়েলের হাতে। শুধু তাই নয়, ফিলিস্তিনি পুলিশ বাহিনীর জনবল, নেতৃত্বের বিষয় নিয়ন্ত্রণের অধিকারও দেওয়া হয়েছে ইসরায়েলের হাতে। গাজার সমুদ্র উপকূল পাহারা দেওয়া থেকে শুরু করে পরিবহণ নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশ, সবই নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে ইসরায়েল।
অভিযোগ আছে, এভাবে সব ধরনের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে থাকায় ফিলিস্তিনকে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণই করতে থাকে ইসরায়েল।
দীর্ঘদিন ধরে এভাবে চলার পর ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের নির্বাচনে হামাস জয়লাভ করে। তখন তারা এক্সিকিউটিভ ফোর্স নামের একটি সরকারি বাহিনী গড়ে তোলে। পরে হামাস ক্ষমতাচ্যুত হলে এই বাহিনী ভেঙে যায়।
এরও পরে ইজদুদ্দিন আল-কাসসাম ব্রিগেড নামের একটি সংগঠন হামাসের সামরিক শাখার দায়িত্ব পালন করে। এই সংগঠনটি ছাড়াও সেখানে আরও কয়েকটি ছোট ছোট সশস্ত্র সংগঠন গড়ে ওঠেছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর মোকাবিলায় তারা সবাই একত্রে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
ফিলিস্তিনের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। ২০০৭ সালে, হামাস গাজার শাসনভার গ্রহণ করে এবং পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণ পায় ফাতাহ দল। এর ফলে দুটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি—হামাস এবং ফাতাহ—একই সময়ে একে অন্যের বিরোধী হয়ে ওঠে। এই রাজনৈতিক বিভাজনও একটি জাতীয় সেনাবাহিনী গঠনের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করেছে।
এদিকে ধারণা করা হচ্ছে ফিলিস্তিনের অর্থনীতি অনেকটাই আন্তর্জাতিক সাহায্য এবং দাতা সংস্থার উপর নির্ভরশীল। একটি পূর্ণাঙ্গ সেনাবাহিনী গঠন এবং তার পরিচালনার জন্য বিশাল বাজেট প্রয়োজন, যা ফিলিস্তিন সরকারের জন্য বাস্তবসম্মত নয়। সীমিত সম্পদ এবং আঞ্চলিক সমস্যা ফিলিস্তিনকে পূর্ণাঙ্গ সেনাবাহিনী গঠনের দিকে ধাবিত হতে দেয়নি।
ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী না থাকার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনৈতিক সংকট, এবং আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। তবে, ভবিষ্যতে এটি একটি পরিবর্তনশীল বিষয় হতে পারে, বিশেষত যদি কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পরিবর্তিত হয়।
ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী গঠনে বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐক্যপূর্ণ সহায়তা, যেমন তুরস্ক, সৌদি আরব, ইরান এবং কাতারের ভূমিকা, ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনের জন্য সহায়ক হতে পারে। এসব দেশ ফিলিস্তিনকে সামরিক প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ এবং রাজনৈতিক সমর্থন প্রদান করতে পারে, যা সেনাবাহিনী গঠনের পথে একটি বড় পদক্ষেপ হতে পারে।
ইসরায়েলিরা দীর্ঘকাল ধরে ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী গঠনকে প্রতিহত করে আসছে, কারণ তারা মনে করে যে, এটি তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। তবে, যদি ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে স্থায়ী শান্তিচুক্তি হতে থাকে, এবং দুই পক্ষের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তবে ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী গঠন সম্ভব হতে পারে।
বর্তমানে ফিলিস্তিনের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল, হামাস এবং ফাতাহ, পশ্চিম তীর এবং গাজায় পৃথকভাবে শাসন করছে। এই বিভাজন ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং সেনাবাহিনী গঠনের সম্ভাবনা ক্ষুণ্ণ করেছে। তবে, ভবিষ্যতে যদি এই দুটি দলের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী গঠনের পথ সুগম হতে পারে।
এর জন্য ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে বিশ্বাস এবং সংলাপের প্রয়োজন। বিশেষ করে যদি হামাস এবং ফাতাহ একত্রিত হয়ে একটি জাতীয় সংহতি সরকার গঠন করতে পারে, তবে ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষেত্রে তাদের সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :