যুদ্ধবিরতি ভেঙে গাজায় ইসরায়েলের টানা হামলায় মাত্র কয়েক সপ্তাহেই নিহত হয়েছে অন্তত ৫০০ শিশু। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পর থেকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে চলছে।
বেসামরিক মানুষ, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা ইসরায়েলি হামলার প্রধান লক্ষ্য- এমনটাই বলছে জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
গাজার সিভিল ডিফেন্স মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল জানান, ১৮ মার্চ থেকে শুরু হওয়া নতুন দফার হামলায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১,৫০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু। জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, যুদ্ধকালীন সময়ে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে ১৫ হাজারের বেশি শিশু এবং আহত হয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার শিশু।
শনিবার (১২ এপ্রিল) গাজার উত্তরাংশের তুফা, মধ্যাঞ্চলের বেইত লাহিয়া এবং দক্ষিণে খান ইউনিসের বিভিন্ন এলাকায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় আরও ১৫ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে এক নবজাতকও ছিল, যার একটি হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং পরে মৃত্যু হয়।
জাতিসংঘের উদ্বেগ নারী ও শিশুই লক্ষ্যবস্তু
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি জানান, ১৮ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইসরায়েল গাজায় ২২৪টি বিমান হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে ৩৬টি হামলায় নিহতদের সবাই নারী ও শিশু।
ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংগঠন ‘আল-হক’ এই তথ্যের ভিত্তিতে জানিয়েছে, ইসরায়েল লক্ষ্যভিত্তিকভাবে নারী ও শিশুকে হত্যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করছে।
বাস্তুচ্যুতি ও অবরুদ্ধ জীবন: নতুন করে ঘর ছাড়ছে লাখো মানুষ
গাজায় চলমান সহিংসতার ফলে বাস্তুচ্যুতির মাত্রা বিপর্যয়কর পর্যায়ে পৌঁছেছে। যুদ্ধবিরতির পর কিছু বাসিন্দা নিজ এলাকায় ফিরতে শুরু করলেও ১৮ মার্চের পর ইসরায়েলের নতুন নির্দেশনায় আবার ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন ৪ লাখেরও বেশি মানুষ।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা জানায়, ইসরায়েলি বাহিনী এই সময়ের মধ্যে ২১ বার ফিলিস্তিনিদের স্থানত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে।
ইসরায়েলি ট্যাংক ঘিরে রেখেছে গাজার শুজাইয়া এলাকা, যেখানে অনেক বাসিন্দা আটকা পড়েছেন। সেখানকার লোকজন জানান, কেউ চলাচল করতে গেলে গুলি চালানো হচ্ছে। একই অবস্থা খান ইউনিসে, যেখানে বহু মানুষ মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছেন।
রাফা ঘিরে কৌশলগত অভিযান: মোরাগ করিডর অবরুদ্ধ
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্ত ঘোষণা দিয়েছেন, দক্ষিণ গাজার ‘মোরাগ করিডর’ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে রাফাকে বাকি গাজার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। গ্যালান্তের দাবি, হামাসকে নির্মূল করতেই এই অভিযান, তবে বিশ্লেষকরা একে গাজার দীর্ঘমেয়াদি দখল পরিকল্পনার অংশ বলে মনে করছেন।
লন্ডনের কিংস কলেজের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. রবার্ট গেইস্ট পিনফোল্ড বলেন, ‘এই করিডরের মাধ্যমে গাজার শহরগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে, যাতে পরবর্তী সময়ে অঞ্চলগুলো ইসরায়েলের কৌশলগত প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়।’
মানবিক বিপর্যয়: ত্রাণ বন্ধ, পানি ও চিকিৎসার তীব্র সংকট
ইসরায়েল ২ এপ্রিল থেকে গাজায় কোনো ত্রাণ ঢুকতে দিচ্ছে না। ফলে ২৩ লাখ মানুষের জন্য খাদ্য, পানি, জ্বালানি এবং চিকিৎসা সামগ্রীর ঘাটতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সংস্থা জানিয়েছে, গাজার ৩৮টি হাসপাতালের মধ্যে ৩৪টিই এখন কার্যত ধ্বংসপ্রাপ্ত। গাজার ৯০ শতাংশের বেশি পানি সরবরাহ ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ত্রাণ ফুরিয়ে যাওয়ায় গাজায় বিভীষিকার দ্বার আবার খুলে গেছে। গাজা এখন একটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে, যেখানে বেসামরিক মানুষ বন্দি হয়ে পড়েছেন।’
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেন, ‘ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ রেখে মানুষকে কষ্টে রাখার মানেই হলো মানবিক সহায়তাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা।’
সূত্র: আলজাজিরা