বর্তমানে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত এক স্লোগান ‘নদী থেকে সাগর পর্যন্ত, ফিলিস্তিন থাকবে মুক্ত’। এই স্লোগানটি আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে, বিশেষ করে ২০২৪ সালের গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধের পর, যখন সারা বিশ্বে এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা মতবিরোধ ছড়িয়ে পড়ে।
এটি ফিলিস্তিনিদের জন্য এক মুক্তির স্বপ্ন, দীর্ঘ ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটি প্রতীকী উচ্চারণ। কিন্তু একই সঙ্গে, এই স্লোগানটিকে ঘিরে রয়েছে নানা ভুল বোঝাবুঝি, রাজনৈতিক বিতর্ক এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া।
এই প্রতিবেদনে আজ আমরা বিশ্লেষণ করব স্লোগানটির উৎপত্তি, এর তাৎপর্য, এবং কেন এটি এতটা সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে।
স্লোগানের উৎপত্তি ও অর্থ
"নদী থেকে সাগর পর্যন্ত" বলতে বোঝানো হয় জর্দান নদী থেকে শুরু করে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত সেই ভূখণ্ডকে, যা ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিন নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে এই ভূখণ্ডের বেশির ভাগই ইসরায়েল রাষ্ট্রের দখলে রয়েছে, এবং বাকিটুকু নিয়ে রয়েছে ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব অঞ্চল- যেমন গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীর।
এই স্লোগানটি মূলত ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। তারা মনে করেন, এই অঞ্চল তাদের পূর্বপুরুষদের ভূমি এবং সেখানে তাদের স্বাধীনভাবে বসবাস করার অধিকার রয়েছে। স্লোগানটির মাধ্যমে তারা সেই অধিকার পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানায়।
ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট
এই স্লোগানটি প্রথম জনপ্রিয়তা পায় বিশ শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে, যখন ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলন তুঙ্গে। প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থা ও অন্যান্য সংগঠন এই স্লোগানটিকে তাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে।
বছরের পর বছর এই স্লোগানটি ব্যবহৃত হয়েছে গণমিছিল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে। এটি অনেকের চোখে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠে।
সমর্থকদের দৃষ্টিভঙ্গি
স্লোগানটির সমর্থকরা বলেন, এটি সহিংসতার আহ্বান নয় বরং একটি ন্যায়বিচারভিত্তিক আহ্বান। তারা বিশ্বাস করেন, এই অঞ্চলে সব ধর্ম ও জাতির মানুষকে সমান মর্যাদা দিয়ে বসবাসের সুযোগ দিতে হবে। “নদী থেকে সাগর পর্যন্ত” বলতে বোঝানো হয় একটি এমন ফিলিস্তিন, যেখানে কোনো ধরনের বৈষম্য বা দমন নেই।
একজন গাজা-নিবাসী শিক্ষক বলেন, ‘আমরা আমাদের সন্তানের জন্য এমন একটি ভবিষ্যৎ চাই, যেখানে তারা নিজ ভূমিতে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে। এই স্লোগান সেই স্বপ্নেরই প্রতিধ্বনি।’
সমালোচকদের দৃষ্টিভঙ্গি
অন্যদিকে, অনেক ইসরায়েলি রাজনীতিক ও পশ্চিমা রাষ্ট্র এই স্লোগানকে হুমকিস্বরূপ মনে করেন। তাদের মতে, এতে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়। কেউ কেউ এটিকে ঘৃণার ভাষা ও বিদ্বেষমূলক প্রচার হিসেবেও ব্যাখ্যা করেছেন।
বিভিন্ন দেশে এই স্লোগান ব্যবহার করলে কিছু স্থানে আইনি পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে। কেউ কেউ একে ‘ইহুদি জাতির বিরুদ্ধে অপপ্রচার’ হিসেবে দেখেন, যদিও এই ব্যাখ্যার সঙ্গে বহু মানবাধিকারকর্মী একমত নন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও বিভাজন
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই স্লোগানকে ঘিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কোথাও এটি স্বাধীনতার প্রতীক, কোথাও আবার এটি আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্সসহ অনেক দেশে এর ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ ও জনগণ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করলেও আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে অনেক সময় প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, “নদী থেকে সাগর পর্যন্ত” এক জটিল বাস্তবতার প্রতীক। এটি যেমন এক জাতির মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, তেমনি আরেক পক্ষের জন্য তা নিরাপত্তাহীনতার প্রতিচ্ছবি। এই দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য না বুঝলে দ্বন্দ্ব কখনোই মিটবে না।
‘নদী থেকে সাগর পর্যন্ত’ স্লোগানটি শুধু একটি বাক্য নয়; এটি ইতিহাস, বেদনা, আশা, সংগ্রাম এবং রাজনৈতিক বিভাজনের প্রতিচ্ছবি। এই বাক্যটির অন্তর্নিহিত অর্থ বোঝার জন্য আবশ্যক সহানুভূতি, ইতিহাসচেতনা এবং ন্যায়বিচারের প্রতি আন্তরিক প্রতিশ্রুতি।
শুধু স্লোগান নিষিদ্ধ করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। বরং এর পেছনে যে দীর্ঘ ইতিহাস, নির্যাতন, ভূমিহীনতা এবং অধিকারবঞ্চনার কাহিনি আছে, তা হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতে হবে। তাহলেই সম্ভব হবে সত্যিকারের শান্তি এবং পারস্পরিক সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরি করা।
আপনার মতামত লিখুন :