ঢাকা মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

ইসরাইলের উত্থান

ফিলিস্তিনে আরবদের স্থানচ্যুতি ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গল্প

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৪, ২০২৫, ০১:৫৬ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম ইতিহাস শুধু একটি নতুন দেশের প্রতিষ্ঠার নয়, বরং এটি মধ্যপ্রাচ্যের একটি বহুবর্ষীয় সংকটের শুরু। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও এই ঘটনার গোড়ার কথা খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হয় ১৯ শতকের শেষ দিক এবং ২০ শতকের শুরুর দিকে। 

ইহুদি জাতীয়তাবাদ , ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতি, এবং আরব জাতীয়তাবাদের উত্থান- সব মিলিয়ে এক জটিল রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামরিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল, যার পরিণতি ছিল ফিলিস্তিনি আরবদের বিতাড়ন এবং ইসরাইল রাষ্ট্রের সৃষ্টি।

প্রাচীন পটভূমি ও ইহুদি জাতীয়তাবাদ

ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিন অঞ্চলে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম সম্প্রদায় সহাবস্থানে বাস করত। তবে ১৯ শতকের শেষদিকে ইউরোপে ইহুদিদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও নির্যাতনের কারণে একটি নতুন রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে-সিয়োনবাদ, যার মূল লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনে একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।

এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন থিওডোর হার্ৎসল। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইহুদি জাতিকে রক্ষা করতে হলে তাদের নিজস্ব একটি ‘জাতীয় আবাসভূমি’ প্রয়োজন, এবং ফিলিস্তিনই তার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান।

বালফোর ঘোষণা (১৯১৭): এক পক্ষের প্রতিশ্রুতি, অন্য পক্ষের উপেক্ষা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার বালফোর ঘোষণা নামে একটি চিঠিতে বলেছিল, তারা ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য একটি ‘জাতীয় আবাসভূমি’ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে। একই সময়ে, ব্রিটিশরা আরবদের প্রতিও স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যদি তারা অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।

এই দ্বিমুখী নীতি পরবর্তীতে ফিলিস্তিনি আরবদের সঙ্গে ব্রিটিশদের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তোলে।

ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ও ইহুদি অভিবাসনের ঢল

১৯২০ সাল থেকে শুরু করে ব্রিটিশরা ‘প্যালেস্টাইন ম্যান্ডেট’ নামে এই অঞ্চল শাসন করতে থাকে। এই সময়ে ইউরোপ থেকে ইহুদি অভিবাসন ব্যাপক হারে শুরু হয়। নাৎসি জার্মানির উত্থান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং হলোকাস্ট ইহুদি জনগণকে প্যালেস্টাইনে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে।

ফলস্বরূপ, ফিলিস্তিনি আরবদের সঙ্গে ইহুদি অভিবাসীদের সংঘর্ষ এবং অসন্তোষ শুরু হয়। ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে বড় ধরনের আরব বিদ্রোহ হয়, যেটি ব্রিটিশ ও ইহুদি মিলিশিয়ারা কঠোরভাবে দমন করে।

জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনা (১৯৪৭)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক মহল ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে পদক্ষেপ নেয়। জাতিসংঘ ১৯৪৭ সালে বিভাজন পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এতে বলা হয়, ফিলিস্তিনকে দুটি আলাদা রাষ্ট্রে ভাগ করা হবে- 
# একটি ইহুদি রাষ্ট্র (৫৫ভাগ জমি)  
# একটি আরব রাষ্ট্র (৪৫ভাগ জমি)  
# জেরুজালেম হবে আন্তর্জাতিক অঞ্চল

ইহুদিরা এ প্রস্তাবে সম্মত হয়, কিন্তু ফিলিস্তিনি আরবরা ও আশপাশের আরব রাষ্ট্রগুলো এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তারা বিশ্বাস করত, এই পরিকল্পনায় তাদের জমি ও অধিকার অন্যায়ভাবে কেড়ে নেয়া হচ্ছে।

স্বাধীনতা ঘোষণা ও যুদ্ধের সূচনা (১৯৪৮)

১৪ মে ১৯৪৮ সালে ডেভিড বেন-গুরিয়ন ইসরাইল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর পরদিনই মিসর, সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন এবং ইরাক- এই পাঁচটি আরব দেশ নতুন ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।  

এই প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ-এ ইসরাইল তুলনামূলকভাবে সংগঠিত ও প্রস্তুত ছিল। ইহুদি আধিপত্যে থাকা গোপন সামরিক সংগঠন হাগানা, ইরগুন, ও লেহি যুদ্ধের আগে থেকেই প্রশিক্ষিত ছিল এবং পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে অস্ত্র ও সমর্থন পেয়েছিল।

ফিলিস্তিনি জনগণের ‘নাকবা’ (বিপর্যয়)

এই যুদ্ধে ইসরাইল কেবল তাদের বরাদ্দকৃত জমিই নয়, বরং অতিরিক্ত অনেক অংশও দখল করে নেয়। এর ফলে প্রায় ৭ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি আরব নিজ ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হন। এই ঘটনার নাম দেয়া হয় নাকবা, যার অর্থ "বিপর্যয়"।

অনেক আরব গ্রাম ধ্বংস করা হয়, ফিলিস্তিনিরা প্রতিবেশী দেশ যেমন জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া ও মিসরে পালিয়ে যায়। এদের মধ্যে অনেকে আজও শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে।

কীভাবে আরবদের হটিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছিল?

# পশ্চিমা সমর্থন: ইসরাইলের প্রতি আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দু’দিক থেকেই তৎকালীন আন্তর্জাতিক সমর্থন ছিল।  
# সামরিক শক্তি ও কৌশল: ইসরাইলি বাহিনী সংগঠিত, আধুনিক এবং অভিজ্ঞ ছিল, যেখানে আরব দেশগুলো বিভক্ত, অসংগঠিত এবং কৌশলগতভাবে দুর্বল ছিল।  
# আরব নেতৃত্বের ভুল: যুদ্ধ শুরুর আগেই আরব দেশগুলোর মধ্যে মতবিরোধ ছিল। কেউ কেউ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র চায়নি, বরং নিজের দখল বাড়াতে চেয়েছিল।  
# অভ্যন্তরীণ সহিংসতা: যুদ্ধ চলাকালে অনেক ফিলিস্তিনি গ্রামবাসী ভয়ে ঘরছাড়া হয়, আবার অনেক ক্ষেত্রেই সরাসরি জোর করে তাড়ানো হয়।  
# পরিকল্পিত বাস্তুচ্যুতি: কিছু ঐতিহাসিক গবেষণা অনুযায়ী, কিছু জায়গায় ইসরাইলি বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে।  

ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম ইতিহাস একদিকে যেমন ইহুদি জাতির “স্বপ্নপূরণ”, অন্যদিকে ফিলিস্তিনি আরবদের জন্য চরম দুঃস্বপ্ন। শতাব্দী প্রাচীন সংঘাত, ধর্মীয় আবেগ, ঔপনিবেশিক নীতির ধ্বংসাবশেষ এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ফল ছিল এই রাষ্ট্রের জন্ম। আজও ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের হারানো জমি ও অধিকার ফিরে পেতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে।

এই সংঘাতের সমাধান এখনো মেলেনি, বরং বারবার নতুন করে সহিংসতা, দখল ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্য দিয়ে এটি আরও গভীর ও জটিল হয়ে উঠছে।

অতিরিক্ত তথ্য:  
# ইসরাইল প্রতিষ্ঠার একবছরের মধ্যেই জাতিসংঘে সদস্যপদ লাভ করে।  
# ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর ইসরাইল আরও অনেক আরব অঞ্চল দখল করে নেয় (যেমন: পশ্চিম তীর, গাজা, গোলান হাইটস)। 
# ১৯৪৮ সালের যুদ্ধেই প্রায় ৪০০+ ফিলিস্তিনি গ্রাম সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেলা হয়।