ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ ঘোষণা করেছেন, গাজায় গঠিত নিরাপত্তা বাফার জোন সমঝোতা হলেও ইসরায়েলি বাহিনী ছেড়ে যাবে না। বুধবার (১৬ এপ্রিল) এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, সাময়িক বা স্থায়ী যেকোনো অবস্থায় এই এলাকা ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
গত মাসে আবারও সামরিক অভিযান শুরু করার পর, ইসরায়েল গাজার ভেতরে ঢুকে একটি বিস্তৃত নিরাপত্তা করিডর তৈরি করেছে। এতে করে প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনিকে দক্ষিণাঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকায় ঠেলে দেয়া হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনীর মতে, তারা এখন গাজার ৩০ শতাংশের মতো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাটজ বলেন, ‘আগের মতো এবার আর আইডিএফ দখল করা এলাকা ছাড়ছে না। এই নিরাপত্তা অঞ্চল থাকবে শত্রু ও ইসরায়েলি জনগণের মধ্যে একটি বাফার হিসেবে- যেমনটি আমরা লেবানন ও সিরিয়াতেও করছি।’
বাফার জোনের পরিধি ও সামরিক দখল
ইসরায়েলি বাহিনী ইতোমধ্যে রাফাহ সীমান্ত শহর দখল করেছে এবং সেখান থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ‘মোরাগ করিডর’ পর্যন্ত অভিযান চালিয়েছে। এছাড়া তারা গাজার কেন্দ্রস্থলের নেতজারিম এবং উত্তরের শেজাইয়া এলাকায়ও অবস্থান নিয়েছে।
ইসরায়েল দাবি করেছে, ১৮ মার্চ থেকে শুরু হওয়া সাম্প্রতিক অভিযানে তারা শত শত হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার রয়েছেন। তবে এই অভিযানে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় দেশগুলো গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
মানবিক সংকট ও উদ্বেগ
জাতিসংঘের মানবিক সংস্থা জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সংঘর্ষে ৪ লাখের বেশি মানুষ গাজায় বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং নিহত হয়েছেন অন্তত ১,৬৩০ জন। আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সংস্থা এমএসএফ গাজাকে একটি গণকবর হিসেবে অভিহিত করেছে। সংগঠনটির জরুরি সমন্বয়কারী আমান্ড বাজারোল বলেন, ‘আমরা বাস্তব সময়ে গাজার জনগণের জোরপূর্বক উচ্ছেদ ও ধ্বংস প্রত্যক্ষ করছি।’
গাজায় খাদ্য, ওষুধ এবং জ্বালানির প্রবেশ বন্ধ করে রেখেছে ইসরায়েল। প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাটজ জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে, তবে এখনই অবরোধ তুলে নেয়া হচ্ছে না। তিনি আরও জানান, যারা গাজা ছেড়ে যেতে চায়, তাদের জন্য বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করা হবে- যদিও এখনো কোনো দেশ বড় সংখ্যায় ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিতে সম্মত হয়নি।
রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও অস্ত্র সমঝোতা
যুদ্ধবিরতির আলোচনা থমকে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে বিরোধ দেখা দিয়েছে। ইসরায়েল বারবার হামাসকে নিরস্ত্রীকরণের আহ্বান জানালেও, হামাস বলছে এটি তাদের জন্য ‘লাল রেখা’।
হামাস জানিয়েছে, ‘যেকোনো যুদ্ধবিরতি যদি পুরোপুরি যুদ্ধ বন্ধ, ইসরায়েলি বাহিনীর প্রত্যাহার, অবরোধ প্রত্যাহার এবং পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করার নিশ্চয়তা না দেয়, তবে তা একটি রাজনৈতিক ফাঁদ হয়ে দাঁড়াবে।’
অব্যাহত সংঘর্ষ ও হতাহত
বুধবার গাজাজুড়ে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৩৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। একটি হামলায় নিহত হন লেখক ও ফটোগ্রাফার ফাতেমা হাস্সুনা, যিনি যুদ্ধের বাস্তবতা নথিভুক্ত করছিলেন। খান ইউনিসে একটি তাঁবুর শিবিরে হামলায় নিহত হন আরও ১০ জন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সীমান্ত বন্ধ থাকায় জ্বালানি, ওষুধ ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে রোগী ও আহত ব্যক্তিরা বিপদের মুখে রয়েছেন।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডাসহ একাধিক দেশ হামাসকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
চলমান সংঘর্ষে গাজার প্রায় ৮০ শতাংশ জনগণ একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অধিকাংশ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে এবং খাবার, পানি ও চিকিৎসার প্রবল সংকট দেখা দিয়েছে।
এ ছাড়া ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের হামলায় ১২শ ইসরায়েলি নিহত ও ২৫১ জন জিম্মি হয়েছিলেন, যার জবাবে ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান চালায়।
গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫১ হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন।