ফাতিমা আবু নাইম, পাঁচ সন্তান নিয়ে অধিকৃত পশ্চিম তীরের একটি পাহাড়ি গুহায় বাস করেন। ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা তার পরিবারের ভেড়া চুরির চেষ্টা করছে। বাড়িতে এসে তার স্বামীকে পরিবার নিয়ে চলে যেতে হুমকি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তিনি বলেন, তারা বলে, ‘চলে যাও, কিন্তু আমি এখানে থাকতে চাই’।
১৮ মাস আগে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের কাছে থেকে এই হুমকি শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে বেদুইনদের পশু চড়ানো পাহাড়ি এলাকা ছাড়তে বলছে তারা।
গত সপ্তাহে প্রকাশিত জাতিসংঘের মানবিক সংস্থা ওসিএইচএ’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেখানে নথিভুক্ত বসতি স্থাপনকারীর সংখ্যার ৪০’র বেশি। এর মধ্যে অর্ধেকই গত মার্চের শেষের দিকে ও এপ্রিলের শুরুতে বেদুইন ও রাখালদের ওপর হামলা করে। তারা তাদের অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর করে ও কৃষিজমি ধ্বংস করে দেয়।
এই হামলার বিষয়ে বার্তাসংস্থা রয়টার্সের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে কোনো মন্তব্য করেনি ইসরায়েলি পুলিশ।
জর্ডান ও ইসরায়েলের মধ্যে প্রায় ৫ হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় পশ্চিম তীর। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল দখল করলে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়, যা চলমান। সামরিক দখলদারিত্বের অধীনে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা দ্রত এ অঞ্চলে ছড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এই ভূখণ্ডকে স্বাধীন রাষ্ট্র বলেই দাবি করে।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অধিকাংশ দেশ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকে অবৈধ বল মনে করে। যদিও ইসরায়েল এর বিরোধিতা করে আসছে। ইসরায়েলের উগ্র ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড সম্পূর্ণ অধিগ্রহণের দাবি করেন।
জর্ডান উপত্যকার জনবহুল এলাকা দক্ষিণ হেব্রন পাহাড়ের কাছে অথবা পশ্চিম তীরের উঁচু এলাকার বেদুইন ও অন্যান্য রাখালরা অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত হুমকি পাচ্ছেন।
গত সপ্তাহে ইসরায়েলি অধিকার গোষ্ঠী পিস নাউ ও কেরেম নাভোটের যৌথ প্রতিবেদন অনুসারে, বসতি স্থাপনকারীরা এই ধরনের চারণভূমির প্রায় ৭৮ হাজার ৬০০ হেক্টর জমি দখল করেছে। যা পশ্চিম তীরের মোট এলাকার ১৪ শতাংশ। আশেপাশের ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদেরও তাদের বাসস্থান থেকে অন্যত্র যেতে হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে।
ওই প্রতিবেদনে অন্যতম লেখক ড্রর এটকেস বলেছেন, ‘জর্ডান উপত্যকা বা দক্ষিণাঞ্চল হলো সেই জায়গা, যেখানে আগে ফিলিস্তিনিদের জন্য বড় বড় তৃণভূমি ছিল। এবং এ কারণেই এই অঞ্চলগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। কিন্তু একটি মানচিত্র দেখলে স্পষ্ট হবেন যে, বসতিগুলো সর্বত্র রয়েছে। তারা আরও বেশি করে নির্মাণ করছে।’
প্রতিবেদনে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে পাওয়া নথি উদ্ধৃত করে দেখানো হয়েছে, পশ্চিম তীরের প্রায় ৮ হাজার হেক্টর জমি (চারণ ভূমি) ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী দখল করে বসতি গড়েছে। আর এজন্য ইসরায়েলিরা সরকারের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য তহবিল, যানবাহন ও অন্যান্য উপকরণ সহায়তা পায়।
দীর্ঘদিন যাবত বসতি স্থাপনকারীদের নির্যাতন পর্যবেক্ষণ করা কেরেম নাভোটের বোর্ডের কর্মী ইগাল ব্রোনার বলেছেন, ‘বেদুইনরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষ করে গাজা যুদ্ধের পর ঝুঁকি আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। তারা পশু চরাতে পারছেন না, পশুর যত্ন নিতে পারছেন না। ফলে তাদের জীবিকা নির্বাহের কোন উপায় থাকে নেই। সত্যিই তারা জীবনযাপনের জন্য সংগ্রাম করছে।’
‘এটা আমাদের দেশ’
ফাতিমা আবু নাইমের পরিবার আল-মুগাইর গ্রামের ঠিক বাইরে। অর্থাৎ দুটি পাথরের গুহার পাশে একটি শিবিরে, যেখানে অনবরত ঝড়ো-হাওয়া বইতে থাকে এই পাহাড়ি এলাকায়। পরিবারটি ইতোমধ্যেই জর্ডান উপত্যকা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। তারা বেদুইনদের চারণ ভূমিতে তাঁবু গেড়েছেন, যেখানে তাদের পশুগুলো চারণ করে এবং হিংস্র বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হন প্রতিনিয়ত।
এখন তারা তৃতীয় বাড়িতে বসবাস করছেন। কিন্তু আবারও অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের আগ্রাসনের শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি তার ছয়টি ভেড়া হত্যা করেছে দখলদার ইসরায়েলিরা। ফাতিমা বলেন, ‘বসতি স্থাপনকারীদের সাথে সমস্যা দেড় বছর আগে শুরু হয়েছিল, কিন্তু গত দুই মাস ধরে আমরা সত্যিই হয়রানির শিকার হচ্ছি। তাদের লক্ষ্য হলো আমাদের এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া। ভেড়াগুলো ঘেরের মধ্যেই থাকে, বাইরে যেতে দেয় না, এমনকি অন্য কিছুতেও না।’
ফাতিমার স্বামী বসতি স্থাপনকারীদের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়েছিলেন। তাকে গত সপ্তাহে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্ত ঠিক কি কারণে- তা জানেন না তিনি।
ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি মানবাধিকার সংগটনগুলো বলছে, পশুপালক সম্প্রদায়ের জন্য কার্যকরভাবে কোনও আইনি প্রতিকার নেই। বরং গাজা যুদ্ধের তিক্ততা পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলেছে।
পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারী আশের মেথ (৬৫) জর্ডান উপত্যকার আইন আল-আউজার ঝর্ণায় বেড়া গিয়েছিলেন। সেখানে নিকবর্তী বেদুইনদের প্রবেশে বাধা দেন তিনি। বলেন, ‘এটি আমাদের ভূমি’। ওদেহ খলিল নামে এক বৃদ্ধ ওই ইসরায়েলির এই বার্তাটি শুনেছেন। তিনি ঝর্ণা থেকে কয়েকশ মিটার দূরের একটি বেদুইন শিবিরে বাস করেন।
গত আগস্টে বসতি স্থাপনকারীদের অভিযানে ৩০০টি ভেড়া হারানোর পর থেকে, তিনি তার অবশিষ্ট পশুদের একটি ঘেরে রাখছেন। ওদেহ খলিল বলেন, ‘মানুষ ভেড়া ছাড়া বাঁচতে পারে না। আমরা চলে গেলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। তারা আমাদের নির্বাসিত করতে চায় এবং বলতে চায় যে, এটি ইসরায়েলি সম্পত্তি।’
আপনার মতামত লিখুন :