ফিলিস্তিনি ফটোসাংবাদিক ফাতিমা হাসৌনা। যুদ্ধের ভয়াবহতা, ইসরায়েলের হামলায় নিজের বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যাওয়া, বারবার ঘর ছাড়তে বাধ্য হওয়া, আর পরিবারের ১১ সদস্যকে হারানোর মতো কঠিন সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তিনি গেছেন। জানতেন মৃত্যু তার দুয়ারে কড়া নাড়ছে।
এ ভয়াবহ বাস্তবতার মধ্যেও ফাতিমার একটিই চাওয়া ছিল– তার মৃত্যু যেন নৈঃশব্দ্যে না হয়; তিনি যেন নীরবে চলে না যান। পৃথিবী জানুক তিনি চলে গেছেন।
কানের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নির্বাচিত ডকুমেন্টারির কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ফাতিমা। ২০২৪ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে মর্যাদাপূর্ণ এসিআইডি সাইডবারের অংশ হিসেবে ‘পুট ইওর সোল অন ইওর হ্যান্ড অ্যান্ড ওয়াকের’ ডকুমেন্টারিটি ঘোষণা করার ঠিক একদিন পরেই হামলা হয় তার বাড়িতে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রোফাইলে ফাতিমা লেখেন, ‘আমি মরলে, আমার সেই মৃত্যু যেন গর্জে ওঠে। আমি যেন শুধু একটুখানি খবর বা কোনো সংখ্যায় পরিণত না হই। আমি চাই, এমন এক মৃত্যু, যা দাগ কেটে যাবে সময়ের বুকে, যার ছবি কেউ মুছে ফেলতে পারবে না।’
গত বুধবার ইসরায়েলি বিমান হামলায় তিনিসহ তার পরিবারের নয়জন সদস্য নিহত হন। উত্তর গাজায় নিজ বাড়িতে একদিন পরই বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল ২৫ বছরের ফাতিমা হাসৌনার। সঙ্গে মারা গেছেন গর্ভবর্তী বোনসহ তার পরিবারের আরও ১০ সদস্য।
গাজা যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ এবং মানবিক ক্ষতিকে নথিভুক্ত করে ফটোসাংবাদিকতার জন্য আন্তর্জাতিক প্রশংসা অর্জন করেছিলেন ফাতিমা। তার মেধাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে পরিচালক সেপিদেহ ফারসি তাকে ‘একটি আলো’ এবং ‘খুব প্রতিভাবান’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
ডকুমেন্টারিটি তৈরি করা হয়েছে তিনি ও ফারসির মধ্যে ভিডিও কথোপকথনের মাধ্যমে। স্বদেশ পতনের দিকে ধাবিত হলেও আশাকে আঁকড়ে ধরে রাখা এক যুবতী নারীর অন্তরঙ্গ চিত্রাঙ্কনের বিষয়কে এতে তুলে ধরা হয়েছে।
ফাতিমার বিষয়ে ফারসি আউটলেটে বলা হয়েছে, ‘তিনি (ফাতিমা) বলেছিলেন, ‘আমি (কানে) আসব, কিন্তু আমাকে গাজায় ফিরে যেতে হবে। আমি গাজা ছেড়ে যেতে চাই না। এখন পুরো পরিবার মারা গেছে।’
নিহতদের মধ্যে ফাতিমার ভাইবোনও ছিলেন, যাদের মধ্যে একজন গর্ভবতী। মাত্র কয়েকদিন আগে, তিনি একটি ভিডিও কলে ফারসিকে তার বোনের বেবি বাম্প দেখিয়েছিলেন।
ফাতিমা সম্প্রতি বাগদান করেছেন। তিনি ফরাসি দূতাবাসের মাধ্যমে ভ্রমণব্যবস্থা সুরক্ষিত করার প্রাথমিক পর্যায়ে ছিলেন বলেও জানা গেছে। ফারসি আশঙ্কা করছেন তার মৃত্যু ঘটনাক্রমে নাও হতে পারে। এর কারণ হিসেবে সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘হয়তো তারা তাকে টার্গেট করেছে, কারণ ছবিটি ঘোষণা করা হয়েছিল।’
এ বিষয়ে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলেছে, হামাস অফিসারের উপস্থিতির কারণে বাড়িটিকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। তবে দাবিটিকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখান করেছেন চলচ্চিত্রটির পরিচালক।
এদিকে, ফ্রান্সের কান প্রোগ্রামে চলচ্চিত্রগুলোকে সংগঠিত এবং সমর্থনকারী সংস্থা এসিআইডি একটি বিবৃতিতে ফাতিমার মৃত্যুকে ‘ভয়াবহ’ বলে অভিহিত করেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘তার হাসিটি তার দৃঢ়তার মতোই জাদুকরী ছিল। এটি সাক্ষ্য বহন করা, গাজার ছবি তোলা, বোমা, শোক এবং ক্ষুধা সত্ত্বেও খাবার বিতরণ করার প্রতীক। আমরা একটি ফিল্ম দেখেছি এবং প্রোগ্রাম করেছি যাতে এই তরুণীর জীবনীশক্তি অলৌকিক থেকে কম কিছু ছিল না। এটি একটি ভিন্ন চলচ্চিত্র, যা আমরা বহন করব, সমর্থন করব এবং কান থেকে শুরু করে প্রতিটি থিয়েটারে উপস্থাপন করব।’
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ জার্নালিস্ট রিপোর্ট করেছে, ফেব্রুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত, গাজায় ইসরায়েল তার সামরিক হামলা শুরু করার পর থেকে কমপক্ষে নিহত হয়েছে ১৫৭ সাংবাদিক।
তবে দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ২০২৩ সাল থেকে ১৭০ জনেরও বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। তবে কেউ কেউ এ সংখ্যা ২০৬ জন বলেও উল্লেখ করেন। নিহতদের মধ্যে আল-জাজিরাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিক রয়েছেন।
আপনার মতামত লিখুন :