যখন ভারতশাসিত কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর স্মরণকালের সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলার খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিভিশনে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন টেলিগ্রাম চ্যাটে একটি বার্তা প্রকাশিত হয়।
আর সেই বার্তায় ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) পর্যটকদের ওপর চালানো ভয়াবহ হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স’ নামে পরিচিত ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ)।
২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার পর বেসামরিক নাগরিকদের ওপর চালানো হামলাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম ভয়াবহ হামলা বলে মনে করা হচ্ছে।
অতীতে কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য লড়াইরত বিদ্রোহীরা সাধারণত পর্যটকদের টার্গেট করতেন না। কিন্তু মঙ্গলবারের এই হামলা সেই বাস্তবতাকে বদলে দিল।
এই ঘটনার পর টিআরএফ গোষ্ঠীটি এবং এর নেপথ্যে থাকা শক্তি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
গোষ্ঠীটি সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো-
টিআরএফ কী
ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, টিআরএফ সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন ফোরামগুলোতে ‘কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স’ নাম ব্যবহার করে এবং সেখানেই তারা ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগাম এলাকায় হামলার দায় স্বীকার করেছে।
দিল্লিভিত্তিক থিংকট্যাংক ‘সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টাল’-এর তথ্য অনুযায়ী, টিআরএফ ২০১৯ সালে আত্মপ্রকাশ করে এবং এটিকে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবার (LeT) একটি শাখা বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২০১৯ সালের আগস্টে ভারত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন দেয়। ওই সময়ই টিআরএফ সক্রিয় হয়।
ওই সিদ্ধান্তের আওতায় বাইরের লোকদের জমি কেনা ও সরকারি চাকরির কোটা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়, যা এই হামলার অন্যতম প্রেক্ষাপট।
টিআরএফ নামটি কাশ্মীরের ঐতিহ্যবাহী ইসলামী নামধারী গোষ্ঠী থেকে আলাদা। নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মতে, এই নিরপেক্ষ নাম ও ‘রেজিস্ট্যান্স’ শব্দটি কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরার কৌশল।
ভারত সরকারের দাবি, টিআরএফ আসলে পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়েবার একটি ছদ্মবেশী শাখা।
পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাদের দাবি, কাশ্মীরিদের শুধু কূটনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন দেয় তারা। পাকিস্তান এই হামলাটিকেও নিন্দা জানায়।
প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র মুম্বাই শহরের ১২টি স্থানে হামলা চালায় লস্কর-ই-তাইয়েবার ১০ জঙ্গি। ওই আক্রমণে ১৮০ জন নিরীহ মানুষ নিহত হন এবং তিন শতাধিক মানুষ গুরুতর আহত হন।
দ্য তাজমহল প্যালেস হোটেল ও ওবেরাই ট্রাইডেন্ট হোটেলের হামলা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। প্রায় ৬৪ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী সেই হোটেল থেকে ২০০ জিম্মিকে মুক্ত করতে পেরেছিল।
টিআরএফ অতীতে কী ধরনের হামলা চালিয়েছে
২০২০ সালের দিকে তারা বিচ্ছিন্ন হামলার দায় নিতে শুরু করে— মূলত টার্গেট কিলিং। ২০২২ সাল নাগাদ সরকারি তথ্যমতে, অধিকাংশ সশস্ত্র যোদ্ধা যারা গুলিতে নিহত হয়, তারা টিআরএফ-এর সঙ্গে যুক্ত।
২০২৪ সালের জুনে, টিআরএফ হিন্দু তীর্থযাত্রী বহনকারী একটি বাসে হামলার দায় নেয়। এতে ৯ জন নিহত ও ৩৩ জন আহত হয়। বাসটি একটি গিরিখাদে পড়ে যায়।
সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের প্রধান অজয় সাহনি মনে করেন, টিআরএফ মূলত লস্কর-ই-তাইয়েবার একটি ফ্রন্ট বা ছদ্মবেশী রূপ।
তিনি বলেন, এই গোষ্ঠীগুলো মূলত গত কয়েক বছরে তৈরি করা হয়েছে।
গোষ্ঠীটি কি ধরনের কার্যক্রমে জড়িত
অজয় সাহনির মতে, এর আগে বড় ধরনের কোনো হামলার দায় সরাসরি এই গোষ্ঠী স্বীকার করেনি। তবে তিনি বলেন, টিআরএফের সমস্ত অপারেশন মূলত লস্কর-ই-তাইয়েবার অপারেশন।
কোথায় হামলা চালানো হবে, সে বিষয়ে তাদের কিছুটা স্বাধীনতা থাকতে পারে, তবে চূড়ান্ত অনুমোদন লস্কর-ই-তাইয়েবা থেকেই আসে।
যেহেতু টিআরএফ পেহেলগামে হামলার দায় স্বীকার করেছে, সেহেতু ধরে নেওয়া যায়, তাদের এই পরিকল্পনার পেছনে লস্কর-ই-তাইয়েবার হাত রয়েছে।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০২৩ সালে পার্লামেন্টকে জানিয়েছিল, জম্মু ও কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার পরিকল্পনা ও সমন্বয়ে টিআরএফ জড়িত ছিল।
মন্ত্রণালয় আরও জানায়, গোষ্ঠীটি সীমান্ত পেরিয়ে নতুন সদস্য সংগ্রহ এবং অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানও সমন্বয় করে থাকে।
সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, দুই বছর ধরে টিআরএফ অনলাইন মাধ্যমে ভারতপন্থি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে হুমকি দিয়ে আসছিল।
পাকিস্তানের বক্তব্য
কাশ্মীরি জঙ্গিদের সমর্থন ও অর্থায়ন করার অভিযোগ পাকিস্তান বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। ইসলামাবাদের দাবি, কাশ্মীরিদের শুধু নৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে থাকে তারা।
তবে কাশ্মীর পরিস্থিতি ও সাম্প্রতিক হামলা ঘিরে নতুন করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। ইতোমধ্যেই ভারতে অবস্থানরত সব পাকিস্তানি নাগরিককে ৪৮ ঘণ্টার মাঝে ভারত ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বহিষ্কার করা হয়েছে বেশকিছু পাকিস্তানি কূটনীতিকদের।
অন্যান্য গোষ্ঠী থেকে টিআরএফ কীভাবে আলাদা
টিআরএফ ইংরেজি নাম ব্যবহার করে ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে ওঠে। তবে তারা গোপন অবস্থানে ফিরে গিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
গোষ্ঠীটির নেতা মোহাম্মদ আব্বাস শেখ ১৯৯৬ সাল থেকে সশস্ত্র লড়াইয়ে যুক্ত ছিলেন। ২০২১ সালে তিনি নিহত হন।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ভারত সরকার টিআরএফকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করে।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, ব্লুমবার্গ, আলজাজিরা
আপনার মতামত লিখুন :