ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার আগে সময় কাটানোর অন্যতম মাধ্যম ছিল বই। তখন অনেকেরই নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস ছিল। অথচ, বর্তমানে আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছি যে, বই পড়ার বিষয়টি খুব কমই চিন্তা করি।প্রতিদিন বই পড়লে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ে এবং আরও সক্রিয় হয়। বই পড়ার উপকারিতা জানতে অসংখ্য গবেষণা হয়েছে। একটি গবেষণা অনুসারে, বই পড়ার অন্যতম প্রধান সুবিধা হলো- আলঝাইমার ও ডিমেনশিয়ার মতো মানসিক রোগের প্রক্রিয়া ধীর করে। এর কারণ বই পড়লে মস্তিষ্ক উদ্দীপিত হয় এবং ব্রেন সচল থাকে। একজন মানুষকে সুস্থ থাকতে শরীরের প্রতিটি অংশের ব্যায়াম প্রয়োজন। মস্তিষ্কের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। নিয়মিত বই পড়লে মস্তিষ্কের ব্যায়াম হয় এবং মস্তিষ্ককে স্বাস্থ্যকর ও সুস্থ রাখে। মানসিক চাপ কমানোর দারুণ একটি উপায় নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস। সাধারণত আমরা প্রতিদিনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকি। যা আমাদের মানসিক চাপ বাড়ায়। এ থেকে মুক্তি পেতে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন।
দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে এরকম মানসিক প্রশান্তিদায়ক বইয়ের ভালো বাজার রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। তবে করোনা মহামারির সময় এ বাজার আরও রমরমা হয়ে ওঠে। কোভিডকালে দক্ষিণ কোরিয়ার এ ঘরানার বই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে গিয়ে বেস্টসেলার তালিকায় আধিপত্য বিস্তার করে। বিটিএসের মতো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ব্যান্ড আর ‘প্যারাসাইট’ ও ‘স্কুইড গেম’-এর মতো হিট সিনেমা-টিভি সিরিজ উপহার দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। এবার দেশটি উপহার দিয়েছে ‘মনের ক্ষত সারানোর দাওয়াই’। দক্ষিণ কোরিয়ার সাম্প্রতিক ট্রেন্ড ক্ষত সারানোর উপন্যাস` হিলিং নভেল`। চলতি মাসেই যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে প্রকাশিত হয়েছে ‘মেরিগল্ড মাইন্ড লন্ড্রি’। প্রকাশের পরপরইর বইটি নিয়ে শোরগোল পড়ে গেছে। এ ঘরানার বইগুলো লেখা হয় ‘বার্নআউট’ নিয়ে। প্রচ্ছদ দেখলে চোখে প্রশান্তির অনুভূতি জাগে। অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদই হয় নজরকাড়া, প্রশান্তিদায়ক রঙের; থাকে প্রকৃতির ছোঁয়া। এসব বইয়ের চরিত্রগুলো জীবনের সব চাপ পেছনে ফেলে আরও অর্থবহ কোনোকিছুর খোঁজ করে। যেমন, কোনো সফল ব্যক্তি সবকিছু ফেলে একটা বইয়ের দোকান দিল। কিংবা কোনো টিভি লেখক চাকরি ছেড়ে দিয়ে মৃৎশিল্পের ক্লাসে যোগ দিল। আত্ম-পরিশুদ্ধির উদ্দেশ্যে চরিত্রগুলো নতুন জায়গায় চলে আসার পর নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে জানাশোনা হয়, সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
জনপ্রিয় কোরিয়ান বই ‘দ্য হিলিং সিজন অভ পটারি’র অনুবাদক ক্লেয়ার রিচার্ডস বলেন, এ ঘরানার বইয়ে মনের জখম সারানোর প্রশান্তিদায়ক ‘এন্তার উপাদান’ থাকে। যেমন, বেড়াল, কিমচি (একধরনের খাবার), আইসক্রিম, কফি। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে এরকম মানসিক প্রশান্তিদায়ক বইয়ের ভালো বাজার রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। তবে করোনা মহামারির সময় এ বাজার আরও রমরমা হয়ে ওঠে। কোভিডকালে দক্ষিণ কোরিয়ার এ ঘরানার বই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে গিয়ে বেস্টসেলার তালিকায় আধিপত্য বিস্তার করে। সামাজিক বিধিনিষেধের সময়ে মানুষে মানুষে সহমর্মিতা ও সহাবস্থানের গল্প তুলে ধরায় এসব গল্প পাঠকদের দারুণ পছন্দ হয় বলে মনে করেন বিদেশি কপিরাইট এজেন্ট জয় লি। ‘হিলিং ফিকশন’ অনলাইনে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে নারী পাঠকরা এ ঘরানার প্রতি আকৃষ্ট হন বেশি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা এ ধরনের বইয়ের নাম জানতে চান। বেশ কিছু বই প্রথমে অনলাইনে বা ‘ক্রাউড ফান্ডিংয়ের’ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এছাড়া কে-পপ তারকাদের উৎসাহী রিভিউয়ের সুবাদে মনের ক্ষত সারানোর এসব গল্প নিয়ে উন্মাদনা আরও বেড়ে যায়। বিষয়টি নজর এড়ায়নি আন্তর্জাতিক প্রকাশকদের। ব্লুমসবেরি, হ্যাচেট, হার্পারকলিন্সের মতো বনেদি প্রকাশনা সংস্থাগুলো কে-হিলিং বেস্টসেলার প্রকাশ করেছে কিংবা স্বত্ব কিনে নিয়েছে। পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউস আগামী চার মাসে এ ঘরানার চারটি বই প্রকাশ করবে।
পেঙ্গুইনের জেন লসন ইকোনমিস্টকে বলেন, কোরিয়ান ফিকশন হুট করেই ফ্যাশনদুরস্ত হয়ে উঠেছে। কোরিয়ান ফিকশনের ‘রীতিমতো বিস্ফোরণ` হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, এই ‘ক্ষত সারানোর’ ট্রেন্ড ‘বিশ্বজুড়ে’ ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক বই প্রকাশের জন্য ১৫-২০টি অঞ্চল চুক্তি করেছে। এ ঘটনায় আরেকটি বিষয় সামনে এসেছে। পাঠকদের মধ্যে অনূদিত ফিকশন পড়ার আগ্রহ বাড়ছে, বিশেষ করে তরুণ পাঠকদের মধ্যে।
বুকার প্রাইজ ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে ব্রিটেনে অনুবাদ করা ফিকশনের বিক্রি বেড়েছে ২২ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক পাঠকদের বয়সই ৩৫ বছরের নিচে। দক্ষিণ কোরিয়ায় ‘হিলিং` উপন্যাসের এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণ কী? অন্যতম একটা কারণ হচ্ছে দেশটির প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি। এ পরিবেশে থাকতে থাকতে মানুষ একসময় হাঁপিয়ে ওঠে। প্রতি দশজনে একজন দক্ষিণ কোরিয়ানের বিষণ্ণতার মতো মানসিক স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সমস্যা আছে।
এসব বইয়ের চরিত্রগুলো কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠে কিংবা বেকার, একের পর এক কাজ খুঁজেই চলে। হুয়াং বো-রিউম-এর বেস্টসেলার ‘ওয়েলকাম টু দ্য হুনাম-দং বুকশপ’-এর উদাহরণ দেওয়া যাক। এ বইয়ের চরিত্র স্নাতক করা শিক্ষার্থী নিজের মনেই আক্ষেপ করে বলে: ‘আমি পড়াশোনায় ভালোৃপ্রচণ্ড পরিশ্রম করি। এই সমাজ কোন সাহসে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়? ‘ওই মেয়ে পরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের বইয়ের দোকান দেয়। জীবনের সব আনন্দ হারিয়ে ফেলা পাঠকের কাঁধে সান্ত্বনার হাত রেখে তাদের একটু স্বস্তি দিতে চান লেখক হুয়াং। এ ঘরানার সাফল্য বলছে, মানুষ সমস্ত চাপ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়। অনেকসময়ই এসব উপন্যাসের স্থান হয় একইসঙ্গে অসাধারণ এবং চিন্তাজাগানিয়া ট্রমা ধুয়ে-মুছে নেওয়া লন্ড্রি, এমন একটি দোকান যেখানে স্বপ্ন কেনা যায়।
বেশ কয়েকটি ‘হিলিং’ উপন্যাসের অনুবাদক শানা তান বলেন, এসব বই ধীরে ধীরে, তারিয়ে তারিয়ে পড়লে উপকার পাওয়া যায়। বিভিন্ন ‘বুক টক’-এ পাঠকরা যেসব কপি নিয়ে আসেন, সেগুলো জুড়ে থাকে তাদের নানা ফুটনোট। বইয়ে লেখা জীবন নিয়ে নানা সদুপদেশের নিচে থাকে দাগ দেওয়া। এ যেন সাহিত্যিক থেরাপি আর থেরাপিস্ট হলো বই।
আপনার মতামত লিখুন :