ঢাকা বুধবার, ০৮ জানুয়ারি, ২০২৫

তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারেই শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েছিল আব্দুস সালাম

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৬, ২০২৫, ০৫:২২ পিএম

তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারেই শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েছিল আব্দুস সালাম

ছবি: সংগৃহীত

একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) তার জনমুখী সাংবাদিকতা এবং নিরপেক্ষ প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে বারবার শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েছে। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ৬ জানুয়ারি। এই দিনটি বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত দিন। ওইদিন গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য সম্প্রচারের জন্য একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যান আব্দুস সালামকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং টেলিভিশনটি দখল করা হয়। মানবাধিকার কর্মী ও গণমাধ্যম বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এ ঘটনাকে নজির হিসেবে ব্যবহার করে অন্য গণমাধ্যমগুলোকেও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

সালটা ছিল ২০১৫। জানুয়ারি মাসের ৬ তারিখ, রাত ৩:২৭ মিনিটে, দাপ্তরিক কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যান ও সিইও আব্দুস সালামের গাড়ির পথ রোধ করা হয়। কালো জ্যাকেট এবং মাস্ক পরা ১০-১২ জনের একটি দল গাড়িটি ঘিরে ফেলে। কিছুক্ষণ বাকবিতণ্ডা চলার পর সালামকে গাড়ি থেকে টেনে বের করার চেষ্টা করা হয়। পরবর্তীতে না পেরে তারাই গাড়িতে উঠে পড়ে। একপর্যায়ে, সেই দলটি সালামকে ফিল্মি স্টাইলে অপহরণ করে জোর করে তুলে নিয়ে যায়।

এ বিষয়ে একুশে টেলিভিশনের ড্রাইভার জানান, প্রথমে তারা নিজেদের ডিবির লোক হিসেবে পরিচয় দেয় এবং বলেছিল, “আমরা ডিবি থেকে এসেছি, আপনাকে নিয়ে যেতে হবে।”

এরপর রাত পেরিয়ে সকাল হলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না যে সালামকে আটক করা হয়েছে কিনা। একুশে টেলিভিশনের সাংবাদিক এবং পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন এবং তেজগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেন। তাদের ধারণা ছিল, সালামকে গুম করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত সেই দৃশ্যটি জাতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায় যে, তাকে একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক এবং জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের যুগ্ম আহ্বায়ক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, “সেই সময় যারা শেখ হাসিনার প্রতি অনুগত ছিল তারা ভালো ছিল, আর যারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমর্থন করতেন, তাদের মধ্যে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যেমন আব্দুস সালাম।”

আব্দুস সালামের সেই গ্রেপ্তার প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেন ডিবির তৎকালীন এসি মাহফুজুল ইসলাম, এডিসি নুরুন্নবী ও এডিসি মেহেদী হাসান। পরবর্তীতে মাহফুজুল ইসলাম কক্সবাজারে এসপি হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় সাবেক সাংসদ বদীর মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। আর এডিসি নুরুন্নবী, যিনি পরে ফেনীর এসপি হন, তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ছিল এবং তিনি শেখ হাসিনার অনুগত বাহিনী হিসেবে কাজ করেছেন। পরে সে ডিবির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার হিসেবে যোগ দেয়। এছাড়া বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সময় ঢাকার ছাত্রজনতার উপর হামলা-গুলিতে নুরুন্নবী ও মেহেদী মাস্টারমাইন্ড ডিবি প্রধান হারুনের নেতৃত্বে কাজ করে।

গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর এই তিন পুলিশ কর্মকর্তাসহ পলাতক আছেন হারুনও। জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের যোগসাজশে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের তত্ত্বাবধানে আব্দুস সালামকে আটক করা হয়।

ব্যারিস্টার কায়সার কামাল আরও বলেন, আইনগত কোনো ভিত্তি না থাকা সত্ত্বেও যাদের হয়রানি করা হয়েছে, তাদের আইনি প্রক্রিয়ায় হাঁটা উচিত এবং যারা এই কাজগুলো করছেন তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। যাতে ভবিষ্যতে অন্য কেউ এই কাজগুলো না করে।

একুশে টেলিভিশন ছিল সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু ২০১৫ সালের ২৫ নভেম্বর টেলিভিশনটি দখল করে নেওয়া হয়। এই ঘটনাটি শুধু একুশে টেলিভিশনকে দুর্বল করেনি, বরং অন্যান্য গণমাধ্যমকেও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল।

এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী ও গুম বিষয়ক কমিশনের সদস্য নুর খান লিটন বলেন, “যদি আপনি মিডিয়াকে ভয়ের পরিবেশে ফেলেন, তবে সেলফ-সেন্সরশিপ শুরু হবে। শুধু সালাম সাহেবকে গ্রেপ্তার করা বা তার বিরুদ্ধে মামলা করা পর্যন্ত বিগত সরকার থেমে ছিল না; আমরা দেখেছি, একুশে টিভির মালিকানা পরিবর্তন, পুরানো সাংবাদিকদের বাদ দিয়ে সরকারের পক্ষে কাজ করা নতুন সাংবাদিকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।”

সিনিয়র সাংবাদিক আশরাফ কায়সার বলেন, “বিগত সরকার মুক্ত গণমাধ্যম নিয়ে গালভরা কথা বললেও, সেই সরকারের বাস্তব কর্মসূচি ছিল ইটিভি দখল করা এবং অন্যদেরকে এমন বার্তা দেয়া যে, যদি তারা সরকারের সঙ্গে না থাকে, তাদেরও একই পরিণতি হবে।”

এই ঘটনা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটিয়েছে। এ বিষয়ে নুর খান লিটন আরও বলেন, “যখন সাংবাদিকরা নিরাপদে কাজ করতে পারেন না, মিডিয়ার মালিকানা জোরপূর্বক পরিবর্তন করা হয়, তখন স্বাধীনতা পূর্ণরূপে ক্ষুণ্ণ হয় এবং এর মাধ্যমে মানবাধিকার স্পষ্টভাবে লঙ্ঘিত হয়।”

এত সবকিছুর পর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে একুশে টেলিভিশন আবারো ফিরে পায় তার স্বাধীনতা এবং মুক্তি পান আব্দুস সালামও। আর এতে করে গণমাধ্যম ও মানবাধিকার কর্মীদের আশা, একুশে টেলিভিশন পুনরায় গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

আরবি/এফআই

Link copied!