লায়েকুজ্জামান

প্রকাশিত: ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪, ০৫:৫৪ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

৬ চ্যালেঞ্জে আওয়ামী লীগ সরকার

৬ চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে নব অভিষিক্ত আওয়ামী লীগ সরকার।

চ্যালেঞ্জ গুলো হচ্ছে: দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রন, তৃনমুলে দলীয় বিরোধের অবসান ঘটানো, বিরোধীদের রাজনৈতিক আন্দোলন শান্তিপূর্ন উপায়ে মোকাবেলা করা, এমপি-মন্ত্রীদের স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করা। বিদেশে অর্থপাচারসহ দুর্নীতি রোধ করা এবং স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজী রোধ করা। আওয়ামী লীগের সামনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

তিনি মোটাদাগে তিনিটি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন, এগুলো হলো রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক। ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, সরকার এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজ করছে, মোকাবেলা করা সম্ভব বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকার বিগত পাচঁ বছরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে তেমন উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাতে পারেনি। সফল হননি ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট সামাল দিতেও। মাত্র তিনটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের হাতে ছিলো সয়াবিন তেলের কারবার, তারা ইচ্ছেমত মূল বৃদ্ধি করেছে, কত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে। একইভাবে চালের সিন্ডিকেট ছিলো কয়েকজনের হাতে। বাণিজ্যমন্ত্রী এগুলো সামাল দিতে হিমসিম খেয়েছেন।

দ্রব্যমূল্য এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। সরকারের বিপুল অর্জন ম্লান হতে বসেছে শুধুমাত্র দ্রব্যমুল্যের কারণে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রনের দিকে সরকারের বিশেষ নজর দিতে হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র কৌশল যেমন কাজে দিয়েছে অন্যদিকে এতে দলের জন্য সুদূর প্রসারী ক্ষতির কারনও হতে পারে। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দিয়েছে ২৬৩ জন অন্যদিকে ২৬৯ জন দলীয় নেতাকর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়েছেন। এদের মধ্যে মনোনয়ন বঞ্চিত ২৮ জন সংসদ সদস্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেছেন। নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে জিতেছেন ৬১ জন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া ২৬৯ আসনেই নৌকা বনাম স্বতন্ত্র সমর্থক হিসেবে দল বিভক্ত হয়েছে। সংঘর্ষ হয়েছে, জীবন হানি ঘটেছে। বিরোধের রেশ এখনো কাটেনি, অনেক জেলায় দল থেকে বহিস্কার, পাল্টা বহিস্কারের ঘটনা ঘটছে। অনেক জেলায় মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে নৌকা বনাম স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থকেরা। গণভবনে ডেকে এনে বিরোধ মিমাংসার চেষ্টা করা হলেও কার্যত: তেমন সুফল মিলেনি এখনও।

বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি, কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি,তার মানে বিএনপি নির্মমূল হয়ে গেছে-একথা বলার সময় হয়নি। বিএনপি গড়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক ধারা থেকে।

বিএনপির শুরু হয় মুসলিম লীগ পরিবারের সদস্য এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী চৈনিক বাম ধারার লোকদের নিয়ে, সঙ্গে ক’জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। দেশে আওয়ামী লীগ বিরোধী সংগঠিত রাজনৈতিক দল হচ্ছে বিএনপি এবং জামায়াত। আওয়ামী লীগ বিরোধী একটি ধারা সব সময়েই থাকবে, অতীতেও ছিলো। একটি শ্রেণী রয়েছে যাদের পূর্ব পুরুষেরা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বা যে কোন কারনে আওয়ামী লীগ তাদের কাছে অপছন্দের। শিক্ষিত এই শ্রেণীটি নিজেদের গায়ে মৌলবাদী তকমা লাগাতে চায় না, এই শ্রেনীটি বিএনপির সমর্থক হিসেবে এখনোও আছে ভবিষ্যতেও থাকবে। এছাড়া বিএনপির হাতে এখনো বিপুল অর্থ রয়েছে এবং অর্থ দেওয়ারমত আর্ন্তজাতিক বন্ধু ও দেশীয় ব্যবসাীয়রাও আছেন। গত ২৮ অক্টোবরের আগে বিএনপি যে সময়ে আন্দোলন বেশ জমিয়ে তুলেছিলো সে সময়ে দেশের দু’টি বড় শিল্প গ্রুপ তারেক জিয়ার কাছে বিপুল অংকের অর্থ পৌছে দিয়েছে বলে খবর চাউর হয়। আওয়ামী লীগকে বিএনপির কর্মসূচী মোকাবেলা করতে হবে অতীতের গতানুগতিক ধারা এড়িয়ে, নতুনভাবে নতুন রাজনৈতিক কৌশলে।

আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকার বিরুদ্ধে ৬১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। বিষয়টি একেবারে সরল দৃষ্টিতে দেখলে হবে না, নৌকার প্রার্থীদের ঘাটতি কোথায় ছিলো, তা চিহ্নিত করার প্রয়োজন রয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে সিংহভাগ হেরেছে সিটিং এমপিরা। আওয়ামী লীগের এত উন্নয়ন, অগ্রগতির মাঝেও, হোক সাধারণ মানুষ বা দলীয় কর্মী, তারা কেন নৌকার বিরুদ্ধে, সিটিং এমপির বিরুদ্ধে গেল? বাস্তবতা হলো, ২০০৮ সালের পর থেকে যারা টানা এমপি হয়েছেন, তারা নিমগ্ন ছিলেন স্বজন প্রীতি ও দুর্নীতিতে। দলীয় কর্মীদের কাছে টানার পরিবর্তে তাদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিলো বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা। ওই সব এমপিরা নির্বাচনী এলাকাকে নিজেদের সাম্রাজ্য মনে করে শাসকের ভূমিকা নিয়েছেন। তাদের কারনে নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষ এমনকি দলীয় কর্মীরা পর্যন্ত নৌকা বিরোধী হয়ে নির্বাচন করেছে। এবার দলীয় এমপিদের লাগাম টানতে না পারলে দিনে দিনে নৌকার প্রতি বিদ্বেষ আরো বাড়বে।


রাজধানীর অলিগলির ফুটপাত থেকে শুরু করে নিভৃত গ্রামের সড়ক পথে অটো চালক পর্যন্ত খেটে খাওয়া লোকগুলো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।

দ্বাদশ সংসদে নির্বাচিত হয়ে আসা রাজধানীর একজন এমপির ছেলে এক রাতে এলাকার
ডিশ, ইন্টারনেট ব্যবসার নিয়ন্ত্রন নিয়ে নিয়েছেন। শেখ হাসিনার নানা ধরনের উন্নয়নে তৃনমুলের এই সব লোকেরা খুশী তবে শেখ হাসিনার সব অর্জন ধুলোয় মিশে যায় যখন সন্ধ্যা বেলায় ফুটপাতের একজন দোকানীকে তার আয়ের বড় অংশটা দলীয় পরিচয়ে পাড়া মহল্লার ছিচকে মাস্তানেরা ছিনিয়ে নেয়।

বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে এটা অস্বীকার করার কোন জো নেই। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী অর্থ পাচারের দোষটা রাজনৈতিক নেতাদের ঘাড়ে পড়লেও এ ক্ষেত্রে আমলারাই বেশী এগিয়ে। দেশের বিপুল পরিমান অর্থ বাইরে না গেলে নিসন্দেহে উন্নয়নের মাত্রা আরো বড়তো। অর্থ পাচার প্রতিরোধ সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে। এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল জয় পেয়ে অনেকটা ফুরফুরা মেজাজে রয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ইতিহাসের বিরল রেকর্ড গড়ে টানা চতুর্থবারের মত প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শেখ হাসিনা। এবারের নির্বাচনী বৈতরনী আওয়ামী লীগ এতটা সহজে, নির্বিঘ্নে পার করতে পারবে এবং সেটা আর্ন্তজাতিক মহলে এত দ্রুত গ্রহনযোগ্য করাতে পারবে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এমনটা কল্পনাও করেননি। ২০০৮ সাল থেকে দেখা যায় প্রতিটি নির্বাচনে শেখ হাসিনা এমন একটি নতুন কৌশল হাজির করেন যা প্রধান বিরোধী দল বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব কল্পণাও করেনি। এবার বিএনপি বেশ আটঘাট বেঁধে নেমেছিলো, আন্দোলনটাও ধাপে ধাপে তৃনমূল থেকে রাজধানীতে নিয়ে এসেছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, এবারের আন্দোলনে বেশ বুদ্ধিমত্তারও ছাপ ছিলো। তবে দু’টি কর্মসূচী বিএনপির তিলে তিলে গড়ে ওঠা সব অর্জনকে বিনাশ করে দেয়। প্রথমটি হচ্ছে ২৯ জুলাই নয়াপল্টনে বড় আকারের একটি সমাবেশ করার পরের দিনই ঢাকার সবগুলো প্রবেশ মূখে অবস্থান কর্মসূচী ঘোষনা করে বিএনপি, উদ্দেশ্য ছিলো ঢাকা অচল করে দেওয়া। এ কর্মসূচী ঘোষণার মধ্যদিয়ে আন্দোলন পেকে ওঠার আগেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বিএনপি। আওয়ামী লীগও ওই অবস্থান কর্মসূচী প্রতিহত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে, বিএনপি কর্মীরা সেদিন মাঠেই দাঁড়াতে পারেনি। এতে বেশ হতাশ হয়ে পড়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা। পরবর্তীতে ২৮ অক্টোবর পুলিশ হত্যা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে আগুন, হাসপাতালে আগুন, বিপুল সংখ্যক সাংবাদিককে পিটিয়ে আহত করা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মধ্যদিয়ে বিএনপি মূলত রাজনৈতিকভাবে আত্মহত্যা করে এবং বিএনপি নেতারা বলতে গেলে দলবেঁধে আওয়ামী লীগের জালে আটকা পড়ে।

তারপরও মার্কিন দূতাবাসের এক কর্মকর্তার দাপাদাপি ও মার্কিন নীতি ও আচরন না বুঝে বিএনপি তাদের ফাঁদে পা দেয়। পৃথিবীর কোন দেশেই মার্কিনীরা পরাজিতদের সঙ্গে থাকে না এবং কাউকে জিতিয়ে আনার দায়িত্বও নেয় না। বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় প্রবীন নেতা বলেন,তারা ইতিবাচক রাজনীতি করতে চাইলেও তারেক রহমানের কারনে তা সম্ভব হয় না, তিনি দেশের বাস্তবতা না বুঝেই কর্মসূচী চাপিয়ে দেন’।

ওই নেতা আরো বলেন, বিএনপি শেখ হাসিনার অধীনেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে দল লাভবান হতো তবে সেটাও সম্ভব হয়নি কারন একমাত্র ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত হলেই মাত্র তারেক রহমান নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি। সব ছাপিয়ে এখনকার বাস্তবতা হলো, টানা চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগ সরকার পথ চলতে শুরু করেছে।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের স্বীকৃতি-সব মিলিয়ে নবগঠিত আওয়ামী লীগ সরকার মোটামুটি ভালো অবস্থানেই আছে বলতে হয়। এখন শুধু চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার পালা।

মন্তব্য করুন