ঝালকাঠি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ০৬:৫৮ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

ট্রাকচাপায় নিহত ১৪ দুর্ঘটনার প্রতিবেদন দাখিল

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ঝালকাঠির গাবখান টোলপ্লাজায় ট্রাক চাপায় ১৪ জন নিহতের ঘটনায় জেলা প্রশাসনে তদন্ত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আজ সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে চালকদের লাইসেন্স ও ট্রাকের ফিটনেস না থাকা, ওভারটেকিং করা, সড়কে অবৈধ যান, সড়কের অবকাঠামোয় ত্রুটি, ট্রাকে ওভারলোড, অতিরিক্ত গতি এবং গতিরোধের জন্য নির্দেশনা না দেওয়াকে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

গত ১৭ এপ্রিল ঝালকাঠির গাবখান সেতু টোলপ্লাজায় সিমেন্টবোঝাই ট্রাক সামনে থাকা একটি মিনি ট্রাক, একটি প্রাইভেটকার এবং তিনটি ইজিবাইককে চাপা দিলে ১৪ জন নিহত হন। আহত হন অন্তত ১৭ জন।

এ দুর্ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বেশ আলোচনার সৃষ্টি হয়। ঈদযাত্রার আলোচিত এ দুর্ঘটনার কারণ জানাতে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এতে জেলা প্রশাসন এবং সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দুটি আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গাবখান সেতুসংলগ্ন দুর্ঘটনার জন্য ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাজিয়া আফরোজকে প্রধান করে সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহিতুল ইসলাম, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ঝালকাঠি জোনের সহকারী পরিচালক (প্রকৌশল) মো. মাহবুবুর রহমান ও বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক ড. আরমানা সাবিহা হককে সদস্য করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

এ বিষয়ে কথা হলে সহকারী অধ্যাপক ড. আরমানা সাবিহা হক বলেন, অনেক সড়ক দুর্ঘটনার তদন্ত করেছি। কিছু বিষয় ছাড়া সড়কের অবকাঠামো ত্রুটি চিহ্নিত করা হয় না। এ ছাড়া দুর্ঘটনা ঘটলে প্রথমেই চালককে দোষারোপ করি। কিন্তু সড়কের অবকাঠামো ত্রুটির বিষয়টি সামনে আনে না কেউ। দুর্ঘটনা কমাতে হলে শুধু সড়কের উন্নয়ন করলেই হবে না, অবকাঠামোগত ত্রুটি দূর করতে হবে।

বুয়েটের এই শিক্ষক বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে প্রধান কারণ হিসেবে সিমেন্টবোঝাই ট্রাকের ওভারলোড এবং অতিরিক্ত গতি দায়ী করা হয়েছে। ট্রাকটির ধারণক্ষমতা ১৫ টন হলেও সিমেন্টের পরিমাণ ছিল ২০ টন। সড়কটিতে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৫০ কিলোমিটার হলেও ট্রাকটি ৬৫ কিলোমিটারের বেশি গতিতে চালানো হয়েছিল। এ ছাড়া ট্রাকচালকের ভারী যান চালানোর লাইসেন্স ছিল না। তিনি ছিলেন বদলি চালক। মূল চালক ঈদের ছুটিতে ছিলেন। সাধারণত বদলি চালকদের দ্রুততম সময়ে ট্রিপ শেষ করার তাগাদা থাকে। তাই এ দুর্ঘটনায় চালকের গাফিলতিও রয়েছে।

অন্যদিকে যেকোনো টোলপ্লাজা ও সড়ক জংশনের ৫০০ মিটার আগেই গতি কমানোর নির্দেশনা থাকে। ‘সামনে টোলপ্লাজা, গতি কমান’ এ ধরনের সাইনবোর্ড থাকে। গাবখান সেতুর ১৩০ ফুট আগে সেই নির্দেশনা ছিল।  কিন্তু সে নির্দেশিকাও (সাইনবোর্ড) চোখে পড়ার মতো নয়। টোলপ্লাজায় গতি নিয়ন্ত্রণে ‘রাম্বল স্ট্রিপস’ থাকার কথা থাকলেও সেখানে তা ছিল না। কাজেই এত অল্প দূরত্বের সাইনবোর্ড দেখে চালক গতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। আর সেতু থেকে নামার পর স্বভাবতই গাড়ির গতি বেশি থাকে, যার ফলেই ঘটে এ দুর্ঘটনা।

ড. আরমানা আরও বলেন, ঝালকাঠি ও পিরোজপুরের সড়কে কিছুটা দূরত্ব পরপর ভয়াবহ বাঁক রয়েছে। গাবখান ব্রিজটিও স্পাইরাল কার্ভের মতো। সেতু থেকে নামার পরে সড়কের দুই পাশে ১২ ফুট করে গভীর খাদ রয়েছে। নিয়মানুযায়ী সেখানে প্রতিবন্ধক থাকার কথা থাকলেও এর দেখা মেলেনি। সড়কের দুই পাশে ১০ মিটার ট্রাভার্সাল ক্লিয়ারিং জোন থাকার কথা। কোনো গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে তা সড়কের পাশে থেকে সেই ক্লিয়ারিং জোনে চলে যাবে। সেখান থেকে গাড়ি নিয়ন্ত্রণে এলে আবার মূল সড়কে এসে চলবে। ঝালকাঠির ওই সড়কের পাশে ক্লিয়ারিং জোন দূরে থাক সেখানে গড়ে উঠেছে নানা অবকাঠামো। গাবখানে যে অংশে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, তার খুব কাছে ছিল চায়ের দোকান। ট্রাক আরেকটু এগিয়ে গেলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারত।

এ ছাড়া নিয়মানুযায়ী সড়কের প্রশস্ত অংশে টোলপ্লাজা হওয়ার কথা। কিন্তু সড়কের সরু অংশে টোলপ্লাজা করা হয়েছে। এটিও ঝুঁকিপূর্ণ। পাশাপাশি সেতু এলাকায় মূল সড়কের পাশে বেশ কয়েকটি সংযোগ সড়ক ছিল। এ ছাড়া ঝালকাঠির সড়কে থ্রি-হুইলার, নছিমন-করিমন, অটোরিকশাসহ নানা অবৈধ যানবাহন চলাচল করে। এসব যানবাহনের কোনো রেজিস্ট্রেশন নেই। এসব বাহনের চালকেরা হুট করে আঞ্চলিক মহাসড়কে চলে আসেন। ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। এসব যানবাহনে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হয়। ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে অধিক প্রাণহানি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

তদন্ত কমিটির এই সদস্য আরও বলেন, ঝালকাঠির দুর্ঘটনার পরে তদন্ত কমিটি বেশ কয়েকটি সুপারিশ প্রস্তাব করেছে। এতে সড়কের যেসব অংশে দুই পাশে গভীর খাদ রয়েছে সেখানে ভরাট করতে হবে। আঞ্চলিক সড়কগুলোর দুই পাশে ট্রাভার্সাল ক্লিয়ারিং জোন তৈরি করা। পাশাপাশি যাত্রী ও পণ্যবাহী পরিবহনে গতি নিয়ন্ত্রক যন্ত্রাংশ (স্পিড ওয়ার্নিং ডিভাইস) বসাতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া সিমেন্টবোঝাই ট্রাকে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত সিমেন্ট পরিবহনের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। ওই সুপারিশমালায় সড়কে থ্রি-হুইলার বা অনিবন্ধিত যানবাহন চলাচলকে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে এগুলো চলাচল বন্ধের জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

ড. আরমানা সাবিহা হক বলেন, গাবখান সেতু এলাকায় মাল্টি  ডিসিপ্লিনারি প্রবলেম ছিল। এখানে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের পাশাপাশি বিআরটিএ, হাইওয়ে পুলিশের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। তাদের জনবল সংকট রয়েছে, কিন্তু যে জনবল রয়েছে তাদের দক্ষতাও কম। সড়ক আইন কার্যকরের বিষয়টি পুলিশের ওপরও বর্তায়। গাবখানে হাইওয়ে পুলিশের কাছে স্পিড রাডার গান ছিল না।

এসব বিষয়ে জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম বলেন, দুঘটনারোধে তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠান হচ্ছে।

 

মন্তব্য করুন