বগুড়া সংবাদদাতা

প্রকাশিত: ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪, ০৩:৫৬ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

মেডিকেলে সুযোগ পেল পিতৃহারা তিন জমজ ভাই, সার্থক রত্নগর্ভা মা

বাবা ছিলেন হাইস্কুলের শিক্ষক। তিনি ২০০৯ সালে মারা গেছেন। সন্তানদের পড়ালেখা করাতে নিজের জমি বিক্রি করেছেন মা। অর্থনৈতিকসহ নানা সমস্যা থাকলেও পড়ালেখা চালিয়ে গেছে। অবশেষে রত্নগর্ভা মায়ের পরিশ্রম সার্থক করেছে তিন সন্তান। বগুড়ার ধুনট উপজেলার বথুয়াবাড়ী গ্রামের তিন জমজ ভাই মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। তিন ভাই হলেন- মাফিউল হাসান, সাফিউল ইসলাম ও রাফিউল হাসান। তাদের বাবা মরহুম গোলাম মোস্তফা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। মা আর্জিনা বেগম একই সঙ্গে জন্ম নেয়া সন্তানদের আগলে রাখেন।

নিজের সর্বস্ব দিয়ে সন্তানদের সুশিক্ষিত হিসেবে গড়তে করে গেছেন লড়াই সংগ্রাম। ফলও পেয়েছেন আর্জিনা বেগম। মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) ধুনট উপজেলার বথুয়াবাড়ী গ্রামে গিয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য পিতৃহারা তিন জমজ ভাইয়ের প্রচেষ্টার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিন ভাইয়ের মাধ্যমিক পড়ালেখা ধুনট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। ২০২০ সালে সেখান থেকে তিন ভাই এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস নিয়ে পাশ করেন। উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য তারা ভর্তি হন বগুড়ার সরকারি শাহ সুলতান কলেজে। ২০২২ সালে গোল্ডেন এ প্লাস পান এই তিন ভাই। ২০২৩ সালে প্রথমবারের চেষ্টায় তিন ভাইয়ের মাঝে শুধু মাফিউল হাসান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এবার সেই আফসোস পুষিয়ে নিয়েছেন বাকি দুই ভাই। এবারের ভর্তি পরীক্ষায় সাফিউল ইসলাম দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল ও রাফিউল হাসান নোয়াখালীর আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজে সুযোগ পেয়েছেন। প্রথমবার পরীক্ষায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের দন্ত বিভাগে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন মাফিউল হাসান। তবে ভর্তি হয়েও মন খারাপ ছিল বাকি দুই ভাইয়ের জন্য।

মাফিউল বলেন, সায়েন্সের ছাত্র হিসেবে সবার মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দিকে ফোকাস করা উচিত। সেই দিকে নিপীড়িত মানুষের কাছে সবচেয়ে খারাপ সময়ে সেবা দেয়ার একটা জায়গা হলো ডাক্তারি পেশা। সেখান থেকে মূলত ডাক্তারি পেশায় আসার প্রবল ইচ্ছা ছিল। সেই কারণে তিন ভাই মেডিকেল প্রিপারেশন নেয়া শুরু করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রথমবার আমার হলেও দুই ভাইয়ের অল্পের জন্য মিস হয়।

সাফিউল ইসলাম বলেন, আমার ইচ্ছা আছে, আমার গ্রামের মানুষ যারা গরীব, দিনমজুর, রিকশাওয়ালা এবং হুজুরদের নিয়ে কাজ করা। আমি যখন ভালো ডাক্তার হবো, ছুটিতে এলে তাদেরকে ফ্রিতে চিকিৎসা দিব। মেডিকেলে ভর্তির জন্য পরিশ্রমের পাশাপাশি ভাগ্যও লাগে মন্তব্য করে রাফিউল জানায়, প্রথমবার না হতে পেরে খারাপ লাগেনি। বরং মনে হয়েছে, এই যে টাকা খরচ হয়েছে তার কিছুটা উসুল হলো। আর আমাদের তো আরেকবার সুযোগ ছিল, তাই ভেঙে পড়িনি।

রাফিউল জানায়, উচ্চমাধ্যমিকে থাকার সময় মেডিকেলে পড়ার স্বপ্ন বোনা করি। সে জন্য মেডিকেলের দিকে ধাবিত হই। ডাক্তারি মহান একটা পেশা। এ পেশার মাধ্যমে মানুষকে সরাসরি সেবা করা যায়। একেবারে হাতেকলমে বলা যায়।

ধুনট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলাম ফারুক বলেন, তিন জমজ আমার ভাতিজা। ওদের বাবা ২০০৯ সালে মারা যাওয়ার পর থেকে ওদের মা সংসারের হাল ধরে। ওদের মা অনেক কষ্টে সন্তানদের পড়ালেখা করিয়েছে।

মেডিকেলে সু‌যোগ পাওয়া তিন সন্তানের রত্নগর্ভা মা আর্জিনা বেগম বলেন, এরা ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় ভালো ছিল। ভালো রেজাল্ট করেছে। আলাদা কোনো গাইড দেয়া লাগেনি। নিজের ইচ্ছায় তারা পড়ালেখা করেছে। পাইলট স্কুল থেকে গোল্ডেন এ প্লাস পায়। তখন ঠিক করলাম, লেখাপড়া ভালো মতোই করাবো। শিক্ষকের ছেলে, যেন তার নাম থাকে। তখন তাদের পিছে টাকা খরচ করেছি, যাতে মানুষের মতো মানুষ হয়। তারপর তারা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। এ জন্য আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। সন্তানদের পড়ালেখা করাতে নিজের জমি বিক্রি করেছেন জানিয়ে আর্জিনা বেগম, আমার শেরপুরে জমি ছিল সেটা বিক্রি করেছি। বাপের বাড়ির জমি ছিল সেটাও বিক্রি করেছি। জমি বিক্রি করেই এতদূর পড়াইছি। এখন সরকার যদি আমার ছেলেদের পড়ালেখার খরচটা দেখে তাহলে উপকার হয়।

মন্তব্য করুন