বান্দরবান প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ৩ এপ্রিল, ২০২৪, ০৯:১৭ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

৩ ব্যাংকে ডাকাতি

থমথমে বান্দরবান জনমনে আতঙ্ক

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বান্দরবানের রুমা উপজেলার সোনালী ব্যাংকে গত মঙ্গলবার রাতে সংঘটিত ডাকাতির রেশ না কাটতেই গতকাল বৃধবার দুপুরবেলা একই উপজেলার কৃষি ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকে উপর্যুপরি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। কর্মকর্তাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে কৃষি ও সোনালী ব্যাংক থেকে
প্রায় ১৭ লাখ ৫৪ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর সন্ত্রাসীরা। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত হতাহত বা অপহৃতের কোন খবর পাওয়া যায়নি। থানচি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মামুন এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, বেলা বারোটার দিকে থানচির শাহজাহানপুরের দিক থেকে বাকলাই সড়ক দিয়ে কেএনএফ সন্ত্রাসীরা তিনটি চাঁদের গাড়িতে করে গুলি করতে করতে বাজার এলাকায় প্রবেশ করে। এরপর থানচি উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন দুটি ব্যাংকে লুটতরাজ চালিয়ে আবার ওই তিন গাড়িতে করে শাহজাহানপুরের দিকে চলে যায়। বাংকে থাকা ভল্ট ভাঙ্গার চেষ্টা চালালে তারা ব্যর্থ হয়। এর আগে ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একটি কক্ষে তালা বদ্ধ করে রাখেন। এসময় লেনদেন অবস্থা থাকার ১৭ লক্ষ ৫৪ হাজার টাক লুটপাট করে নিয়ে যায় কেএনএফ সন্ত্রাসীরা। এদিকে টানা দুদিন ধরে উপুর্যপরি ডাকাতির ঘটনায় বান্দরবানজুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। পুরো জেলার জনজীবন জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় সেনাবাহিনী এবং পুলিশের টহল বাড়িয়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। জেলার সাত উপজেলার প্রত্যেকটি ব্যাংকে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে লেনদেন।

এদিকে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এসময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রুমার সোনালী ব্যাংকের নিরাপত্তা কর্মীদের মারধর করে পুলিশ ও আনসারের কাছে থাকা অস্ত্র ও গুলি লুট করে নিয়ে গেছে। একই সাথে ব্যাংক ম্যানেজারকেও অপহরণ করে নিয়ে গেছে তারা।

সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে আইজিপি আরো জানান, পাহাড়ে সন্ত্রাস দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা নাই এটা ভাবার কোন যুক্তি নাই। বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের সন্ত্রাস দমনে আরো বেশি সক্ষমতা রয়েছে। পাহাড়ে যারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাচ্ছে তাদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে।

একইদিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন ও পুলিশ সুপার সৈকত শাহিনসহ উর্ধতন ককর্মকর্তারা। পরিদর্শন শেষে জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, প্রাথমিক ভাবে যেটি যাচাই-বাছাই করেছি সেটি হল ব্যাংকে থাকার যে ভল্ট সেটি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে এবং সেখান থেকে অর্থ নিয়ে গেছে কীনা সেটা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। সেটি সিআইডি টিম এসে পরিক্ষানিরিক্ষার পর জানানো যাবে। এদিকে ডাকাতির ঘটনা তদন্তে কক্সবাজার থেকে পিবিআইয়ের পাঁচ সদস্যের একটি টিম গতকাল দুপুরে রুমা পরিদর্শন করেছে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, পিবিআই ও ব্যাংকের তদন্ত টিমের কাজ শেষে বলা যাবে ভল্ট থেকে টাকা খোয়া গেছে কি না। অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজার নিজাম উদ্দিনকে উদ্ধারে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কয়েকটি টিম অভিযান পরিচালনা করছে।

পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে ব্যাংক লুটপাট করার পর যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল তাদের কাজ থেকে এসমজি, রাইফেলসহ ১৪টি অস্ত্র ও ৪১৫ রাউন্ড গুলি নিয়ে গেছে। এই ঘটনায় যারা জড়িত রয়েছে তাদেরকে দ্রুত আইনে আওতায় আনতে সক্ষম হবো।

অন্যদিকে বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) আবদুল করিম গত মঙ্গলবার রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, গতকাল (মঙ্গলবার) রাত ৯টার দিকে কেএনএফের প্রায় ১০০ অস্ত্রধারী সদস্য এই হামলায় অংশ নিয়েছে। হামলাকারী অনেকের গায়ে কেএনএফের লোগোসহ পোশাক ছিল। হামলার শুরুতে সন্ত্রাসীরা উপজেলা পরিষদের দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যদের মারধর করে অস্ত্র ও মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়।

তিনি বলেন, সোনালী ব্যাংকের ওই শাখার ম্যানেজার মো. নিজাম উদ্দিনকে অপহরণ করা হয়েছে। গত ১৬ ঘণ্টা ধরে অভিযান পরিচালনা করেও তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রুমা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈ বং মারমা বলেন, ব্যাংককর্মীরা যখন নামাজ পড়ছিলেন, ঠিক তখনই হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় ম্যানেজারকে অপহরণের পাশাপাশি নিরাপত্তার কাজে ব্যবহৃত বেশ কিছু অস্ত্র ও মোবাইল ফোন সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা নিয়ে গেছে।

ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, সন্ত্রাসীরা উপজেলা কমপ্লেক্সের বাউন্ডারির ভেতরে থাকা মসজিদে ঢুকে প্রথমে দরজা বন্ধ করে দেয়। তখন তারাবি নামাজের জন্য অনেক কর্মকর্তা সেখানে ছিলেন। শুরুতেই নামাজরত সবাইকে বন্দি করে সন্ত্রাসীরা মারধর করে সঙ্গে থাকা টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। পরে তারা ব্যাংক ম্যানেজারকে জিম্মি করে ব্যাংকে নিয়ে যায় এবং ব্যাংক লুট করে।

রুমা উপজেলা পরিষদের মসজিদ ইমাম নুরুল ইসলাম বলেন, রাত ৮টার দিকে তারাবি নামাজ শেষে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট কেএনএফ সন্ত্রাসীরা সবাইক ঘেরাও করে জিম্মি করে রাখে। পরে তারা বাংকের লুটপাট শেষে সবার কাছ থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়।

রুমা শাখা সোনালী ব্যাংকের ক্যাশিয়ার উথোয়াই চিং মারমা বলেন, সন্ত্রাসীরা মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে পকেট থেকে ভল্টের চাবি নিয়ে নেয়। চাবির সাথে কাছে থাকা টাকা ও মোবাইল ও ছিনিয়ে নেয়। পরে তারা ব্যাংকের ভল্ট খুলতে না পেরে ম্যানেজারকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।

জানা গেছে, গত বছরের ৫ নভেম্বর মুনলাই পাড়াতে কেএনএফের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দু পক্ষে চারটি বিষয় নিয়ে সমঝোতা স্বাক্ষরিত করা হয়। কিন্তু চারটি বিষয়ের মধ্যে দুটি বিষয়ে শর্ত ভঙ্গ করে কেএনএফ সদস্যরা। এরপর চলতি বছরের ৫ মার্চ কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির দ্বিতীয় দফা সংলাপ হয়। রুমা উপজেলার বেথেলপাড়া কমিউনিটি সেন্টারে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। চলতি মাসের মাঝামাঝি আবারও বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় সেই সংলাপের এক মাসের মাথায় গত মঙ্গলবার বান্দরবানের রুমা উপজেলা সদরে সোনালী ব্যাংকে হামলার ঘটনা ঘটে। বেথেলপাড়ায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে কোন ধরনের সন্ত্রাসী হামলা না চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কেএনএফ।

বান্দরবানে নতুন সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে তৎপরতা শুরু করে। পাহাড়ে তাদের আস্তানায় সমতলের নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিল বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এর আগে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল। ওই আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত বছর অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া ও কেএনএফের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে। কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ কমিটি গঠন করা হয় গত বছরের মে মাসে। এরপর থেকে কমিটি কেএনএফের সদস্যদের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে আসছে।

মন্তব্য করুন