রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ৩১ মে, ২০২৪, ০৩:৫৯ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

বিষয়টি জানত প্রভাবশালী মহল

পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সিঙ্গাপুরে বেনজীর

ছবি: সংগৃহীত

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ পুলিশের মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রভাবশালী। দায়িত্ব পালনের সময় অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। তিনিসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে তলবও করেছে।

কিন্তু এরই মধ্য তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চলে গেছেন সিঙ্গাপুরে। চলতি মাসের ৪ তারিখ রাতে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে করে তিনি দেশত্যাগ করেন বলেন পুলিশের একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছে।

ওই সূত্র বলেছে, স্ত্রীর চিকিৎসার কথা বলেই তিনি দেশের বাহিরে যাচ্ছেন বলে তার স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের বলেছেন। তবে প্রভাবশালী মহলের একাংশ দেশ ত্যাগের বিষয়টি অবহিত করেই তিনি দেশ ছেড়েছেন।

নাম প্রকাশ না করে বেনজীর আহমেদের ঘনিষ্ঠ এক পুলিশ কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, দুদকে তলব করাসহ সবকিছুর বিষয়ে তিনি আগাম ওয়াকিবহাল ছিলেন। প্রভাবশালী একটি মহল তাকে আগাম সবকিছু বলে দিয়েছিল। তবে তিনি বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে খুবই বিব্রত।

তিনি আরও বলেন, সব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিনি একটি আইনজীবী প্যানেল ঠিক করেছেন। সরকারের শীর্ষ মহলকেও বুঝানোর চেষ্টা করছেন যেভাবে বলা হচ্ছে সেইভাবে তিনি কোন অপরাধ করেননি। দুদকের তলব করার বিষয়ে তিনি সময় চাইতে পারেন বলে আমরা শুনেছি। হয়তো তার আইনজীবী দুদকে আবেদন করতে পারেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলে তিনি দেশে আসবেন। আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এই পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশও আছে অস্বস্তিতে।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, তারা বিশ্বাসই করতে পারছেন না বেনজীর আহমেদ এসব করতে পারেন। তবে এ নিয়ে কেউ মুখ না খুললেও অনেকেই বলেছেন পুলিশের বিরুদ্ধে এমনিতেই নানা অভিযোগ আছে।

জানা গেছে, আগামী ৬ জুন বেনজীর আহমেদকে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তলব করা হয়েছে। আর ৯ জুন তার স্ত্রী ও তিন সন্তানকে ডেকেছে সংস্থাটি।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলেছেন, অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে আইনের দ্বারস্থ হতেই পারেন বেনজীর আহমেদ। আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার আছে তার। পুলিশের আইজি হওয়ার আগে ডিআইজি এবং অ্যাডিশনাল আইজিপি হতে হয়েছে বেনজীর আহমেদকে। প্রতিটি পদে পদোন্নতি পেতে হলে চাকরিজীবনের শ্রেষ্ঠত্ব ছাড়াও, বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে তাদের চরিত্র ও কাজকর্ম বিশ্লেষণ করা হয়। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য-উপাত্ত ও তথ্য বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন দিয়ে সরকারকে সাহায্য করেছে, অবশ্যই এসব রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে তাকে আইজিপি পদে পদস্থ করেছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা। তার কর্মকাণ্ড মনিটরিং করা উচিত ছিল। এখনো যেসব পুলিশ সদস্য আছেন, তাদের কর্মকাণ্ডও মনিটরিংয়ের আওতায় আনা জরুরি।

বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, পুলিশের কোনও সদস্য অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে বিচারের বিধান থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা কার্যকর হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে ফৌজদারি অপরাধের বিচারও করা হয় বিভাগীয় আইনে। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের ‘বিভাগীয় শাস্তির আওতায় আনার কথা বলে অপরাধ আড়াল করার অভিযোগ রয়েছে।

দুদক সূত্র জানায়, অভিযোগ ওঠার পর বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক স্বজনের নামে থাকা ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি ক্রোক বা জব্দের আদেশ দিয়েছে আদালত। একই দিন বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে থাকা ৩৩টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) অবরুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়। তা ছাড়া জীশান মীর্জার নামে থাকা মাদারীপুরে ২৭৬ বিঘা (৯১ একর) জমি এবং বেনজীর পরিবারের নামে থাকা গুলশানের চারটি ফ্ল্যাটও জব্দের আদেশ দেয় আদালত। বেনজীর পরিবারের নামে থাকা ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসা করার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র অবরুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়। সাভারে তাদের কিছু জমিও পড়েছে একই আদেশের মধ্যে। ইতিমধ্যে সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন বেনজীর আহমেদ। এর আগে তিনি   ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র‍্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‍্যাব এবং র‍্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাদের মধ্যে বেনজীর আহমেদের নামও ছিল। ওই সময় আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

পুলিশ সূত্র জানায়, নানা রকম অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন পুলিশের কতিপয় সদস্য। পেশাদার অপরাধীর মতোই মাদক কারবার, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। পুলিশের পোশাক পরেই করছেন এসব অপকর্ম। মাঝেমধ্যে ধরা পড়ছেন দু-চারজন, বাকিরা থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অসাধু এসব পুলিশ সদস্যের আচরণ পুরো বাহিনীকে ইমেজ-সংকটে ফেলছে। আবার কারও কারও বিরুদ্ধে জোর করে অর্থ আদায়, জমি দখল, মাদক পাচার, পরকীয়া, ঘুষের বিনিময়ে পোস্টিং বাণিজ্য, টাকা না পেয়ে গ্রেপ্তারের হুমকি, যানবাহন আটকে অর্থ আদায়, সহকর্মীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ, চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণাসহ নানা অভিযোগ আছে। প্রতিদিনই আইজিপিসহ পুলিশের সব ইউনিট প্রধানের কাছে অভিযোগ আসছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ১৩ নভেম্বর সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক আইজিপি কমপ্লেইন সেল চালু করার পর থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে বেশি। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় পুলিশ কর্মকর্তারাও অনেকটা বিব্রত। এই নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পুলিশের অপরাধ রুখতে প্রতিটি জেলায় গোয়েন্দাদের নিয়ে বিশেষ টিম গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জিরো টলারেন্সনীতি গ্রহণ করতে বলা হয়েছে বৈঠকে। ইতিমধ্যে জেলা পুলিশ সুপাররা টিম গঠনের কাজ শুরু করেছেন।

মন্তব্য করুন