ওমর ফারুক

প্রকাশিত: ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ০৯:৫০ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

রেখেছো ভিলেন করে, মানুষ কর নি

ছবি সংগৃহীত

গত ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় এক সাংবাদিক বন্ধুকে ফোন দিলাম। আমার সেই সাংবাদিক বন্ধুটি আামকে বললো, 
- দোস্ত আমি এফডিসিতে একটু প্যারায় আছি, তোকে পরে ফোন দিচ্ছি! 

- ওকে, শেষ করে ফোন দিস, জরুরী কথা আছে। 

এই বলে ফোনের লাইন ডিসকানেক্ট হতেই মনে পড়লো। আগামী কাল (১৯ এপ্রিল) তো দেশের সবচেয়ে আলোচিত (শিল্পী সমিতির) নির্বাচন। আর ঐ দিনটি ঘিরে তো বিনোদন সাংবাদিকরা প্যারায় থাকবেই। 

ঠিক ঘন্টা তিনে’ক পরে ঐ বন্ধুর ফোন, 
- দোস্ত বল কি তোর জরুরী কথা।
- আগে তোর কথা বল, এতক্ষন এফডিসিতে কি করলি?
- আরে আগামীকাল (১৯ এপ্রিল) শিল্পী সমিতির নির্বাচন তো, তাই নিউজ কভারেজ করার জন্য পাশ নিতে এত দেরি হয়ে গেলো! 
- বলিস কি, তা কত জন সাংবাদিককে পাশ দিলো শিল্পী সমিতির নির্বাচন কমিশন? 

উত্তরে ও যে সংখ্যাটা বললো তাতে আমার চোখ ছানাবড়া! যারা এই লেখাটা এই মুহুর্তে পড়ছেন, একটু অনুমান করুন তো দেশে বিনোদন সাংবাদিকের সংখ্যা কত? যদি দেশের সকল বিনোদন সাংবাদিক ঐদিন শিল্পী সমিতির নির্বাচন কভার করে তাহলে আপনার সমীকরণে এই সংখাটা কত হবে? ২০০/ ৩০০! আপনার উত্তর যদি এটা হয় তাহলে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। এবারের শিল্পী সমতির নির্বাচনে ৪০০ জনেরও বেশি বিনোদন সাংবাদিককে নাকি সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য পাশ কার্ড দিয়েছে শিল্পী সমতির নির্বাচন কমিশন। 

সংবাদ সংগ্রহের জন্য এই পাশ কার্ড? নাকি এফডিসিতে লোক সমাগম দেখাতে এই আয়োজন আমার বোধগম্য নয়। 

যাই হোক, গতবারের নির্বাচন থেকে এবারের নির্বাচন অনেক শান্তিপূর্ণ, ত্রুটিমুক্ত হয়েছে এটা বলাই যায়। নেই কোন অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের খেলা। সাধারণত সিনেমার পর্দায় সব সময় নায়ক নায়িকার জয় হলেও এবারের শিল্পী সমিতির নির্বাচনে হয়েছে তার উল্টো। নায়ক-নায়িকাকে পরাজিত করে জয়ী হয় খলনায়ক প্যানেলের। 

সবকিছু ঠিক থাকলেও বিপত্তি বাঁধে নব নির্বাচিত কমিটির শপথ গ্রহণের দিন। শিল্পী সমিতির শপথ ঘিরে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (এফডিসি) ছিল চাঞ্চল্যকর অবস্থা। প্রথম বিপত্তি বাঁধে শপথ পড়ানো নিয়ে। নিয়ম অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার শপথ পড়ান;নতুন সভাপতিকে। পরে সভাপতি বাকিদের পড়ান। প্রধান নির্বাচন কমিশনার খোরশেদ আলম খসরু শপথস্থলে উপস্থিত থাকলে নতুন সভাপতিকে শপথ পড়িয়েছেন পরিচালক কাজী হায়াৎ। এটা নিয়ে মনোমালিন্য তৈরি হয়েছে।

এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার খোরশেদ আলম খসরু তাৎক্ষনিক বিবৃতিও দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে অস্মমানিত করা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী শপথ পড়ানোর কথা আমার। আমি যদি অপারগতা প্রকাশ করি তাহলে সাবেক সভাপতি বিজয়ী সভাপতিকে শপথ পড়াবেন এরপর নতুন সভাপতি বাকিদের সভাপতি শপথ পড়াবেন। কিন্তু সেটি তারা করেননি। তারা আমাকে অপমানিত করছেন। এতো গেলো রুমের ভেতরের ঘটনা। বাইরের ঘটনা আরও ভয়ংকর ও লজ্জাজনক। 

শপথ অনুষ্ঠান শেষে বিনোদন সাংবাদিকদের উপর হামলা করে কয়েকজন শিল্পী। এদের মধ্যে আছেন খল অভিনেতা শিবা শানু, নবনির্বাচিত শিল্পী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক জয় চৌধুরী ও সহসভাপতি নায়ক রুবেল। তাদের নেতৃত্বেই জুনিয়র শিল্পীরা সাংবাদিকদের মারধর করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় ১৭ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকজনের যখম গুরুতর। আছেন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঘটনার পরপরই কয়েকটি ভিডিওক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে। ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নির্বাচিত শিল্পী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক জয় চৌধুরীর সাথে সাংবাদিকদের কথা কাটাকাটি। এক পর্যায়ে তাকে বেশ উত্তেজিত হয়ে মার মার বলে লাথি মারতেও দেখা যায়। আরেকটা ভিডিওতে দেখলাম এক সাংবাদিক ট্রাইপড হাতে দৌড়াচ্ছেন সম্ভবত তাকে ধাওয়া দিচ্ছেন ভিলেন শিবা শানু।

দৈনিক সমকালের প্রতিবেদন বলছে মদ্যপ ছিলেন শিবা শানু, মারামারিতে নেতৃত্ব দেন জয় চৌধুরী। মনের অজান্তেই প্রশ্ন জাগে শিল্পীদের এ কেমন আচরন?

আরও দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে এই ঘটনায় বিনোদন সাংবাদিক সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। সাংবাদিকদের মধ্যে দালাল বহু আগে থেকেই আছে। আবার দালালদের মধ্যে কেউ কেউ সাংবাদিকতা করতে এসেছে। যা লজ্জার এবং রীতিমত আতঙ্কের।  

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন শিল্পী ও একাধিক সাংবাদিকদের একাধিক পোস্টের মাধ্যমে জানলাম, ঘটনার সুত্রপাত চিত্রনায়িকা ময়ূরীর মেয়েকে প্রশ্ন করা কে কেন্দ্র করে। কোন সাংবাদিক নাকি ময়ূরীর মেয়েকে প্রশ্ন করেছেন 'আপনার মায়ের অশ্লীল সিনেমা দেখেন কিনা?  যদিও বেশিরভাগ সাংবাদিক বলছে, প্রশ্নটা ছিলো 'আপনার মায়ের সিনেমা দেখেন কিনা? তার মানে মূল ঝামেলা অশ্লীল শব্দটি নিয়ে। 

একজন সাংবাদিক যে প্রশ্নই করুক না কেন, তাই বলে তার গায়ে হাত তুলতে হবে? আলোচনা করে কি সমাধান করা যেত না?

আবার এ ও শুনলাম শিবা সানু নাকি ঐ সাংবাদিককে প্রশ্ন করেছে, তুমি কি সাংবাদিক নাকি ইউটিউবার?

এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ইউটিউবার এফডিসিতে ঢুকলো কি করে? কি কারণে? তাদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে গেলো কে ? ইউটিবার কেন এফডিসিতে এই জবাব কে দেবে? যদিও অভিযোগ আছে অনেক শিল্পীই নাকি ইউটিউবার পোশে। যে ৪০০ জনকে শিল্পী সমিতির নির্বাচনে সংবাদ সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া হয় সেই তালিকায়ও নাকি শতাধিক ইউটিউবার আছে। এই হলো আমাদের এফডিসি!

সাংবাদিকদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন ডিপজল-মিশা। সংগঠনটির পক্ষ থেকে তারা বলেছেন, দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখন দেখা যাক তারা কি ব্যবস্থা নেন এবং তা কতদিনে নেন। নাকি সবাইকে ডেকে আবার বলেন বিনোদন সাংবাদিক আর শিল্পীরা ভাই-ভাই। যে ঘটনা ঘটেছে সেটা নিছকই ভুল বোঝাবুঝি! 

একজন গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে আমি অভিযুক্ত শিল্পীদের দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি দাবী করছি। 

ছোটবেলায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বঙ্গমাতা’ কবিতার শেষ দুই লাইন ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী/রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।’ পড়ে বিরক্ত হতাম। নিজ জাতিসত্তা নিয়ে কবির অসম্মানসূচক মন্তব্যে আত্মসম্মানবোধে আঘাত লাগতো কিছুটা। ভাবতাম কবিগুরু নিজে বাঙালি হয়েও কি করে এসব লিখতে পারলেন? কিন্তু কাউকে বলতে পারতাম না। ভয় পেতাম কবিগুরুর লেখা নিয়ে মন্তব্য! 

কিন্তু শিল্পী সমিতির কতিপয় শিল্পীদের বর্বর আচরণ দেখে কবিগুরুর স্বরের সাথে স্বর মিলিয়ে উচ্চস্বরে বলতে ইচ্ছে করে, ‘এত এত অভিনেতারে, হে মুগ্ধ জননী /রেখেছো ভিলেন করে, মানুষ করো নি।’  

লেখক: যুগ্মবার্তা সম্পাদক, দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ
 

মন্তব্য করুন