সিলেট ব্যুরো

প্রকাশিত: ২৩ জুন, ২০২৪, ১১:১৮ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

সিলেটে বন্যার চার কারণ, নদী খননে জোর বিশেষজ্ঞদের

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সুরমা ও কুশিয়ারার নাব্যতা সংকট, হাওরে অপরিকল্পিত সড়ক-বাঁধ নির্মাণ ও হাওর-বিল-ঝিল ভরাট, নির্বিচারে পাহাড়-টিলা কাটা এবং উজানে (ভারতে) স্লুইচগেট নির্মাণ-সিলেটে নিয়মিত বন্যার জন্য এই ৪ কারণকে বড় করে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বড় দাগের এই কারণগুলোর পাশাপাশি আরও কয়েকটি 'দায়'-এর কথা জানিয়েছেন তারা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিলেট জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস বলেন, মেঘালয়ের অতিবৃষ্টি সিলেটকে চরম ভাবে আক্রান্ত করে। সেখানে বৃষ্টিপাতের কারণে যে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়, এর সবই চলে আসে সিলেটে। সেই ঢলে আসা পাহাড়ি বালু-মাটি-পলি জমতে জমতে নদ-নদীগুলো প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। এতে নদীগুলো ক্রমে সংকীর্ণ ও ভরাট হয়েছে। পাশাপাশি যেখানে-সেখানে স্লুইসগেট ও অবকাঠামো নির্মাণের কারণেও নদীর প্রবাহপথ আরও বেশি সংকুচিত হয়েছে। যে কারণে বৃষ্টির পানিতেই বন্যায় এত ভয়াবহতা।

আর সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. নাসরিন সুলতানা লাকি বলেন, মেঘালয় ও আসামের শিলচর-করিমগঞ্জ এলাকার ঢল সিলেটে বন্যার জন্য অনেকটা দায়ী। উজানের পানি এক সময় বিনা বাঁধায় নেমে যেতে পারতো। এখন সেই সুযোগ কমে আসছে। ঢলের পানি নানান জায়গায় নানান ভাবে বাঁধা পাচ্ছে তার স্বাভাবিক গতিতে। ফলে পানি নামায় ধীর গতির কারণে দেখা দিচ্ছে বন্যা।

বন্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী? বিশেষজ্ঞরা এরও সমাধান দিয়েছেন। বলছেন, এ অবস্থা থেকে খুব সহজে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়, তবে দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ সিলেটকে বন্যা থেকে যথেষ্ট নিরাপদ রাখতে পারে। নদ-নদীগুলোর নাব্য বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-শাবিপ্রবি'র পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক জহির বিন আলম বলেন, সিলেটের প্রধান দুটি নদী সুরমা ও কুশিয়ারাসহ অন্যান্য নদ-নদী খনন করা এবং সিলেট নগরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত প্রাকৃতিক ছড়াগুলো দখলমুক্ত করে খনন করতে হবে।এভাবেই পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক পথ নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি হাওর ও বিলে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহের বাঁধা দূর করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রায় ২৪৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সুরমা ভারতের বরাক নদী থেকে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। এই নদী বছরের বেশির ভাগ সময় থাকে পানিহীন, মৃতপ্রায়। পলি জমে ভরাট হয়ে পড়েছে নদীর তলদেশ। ফলে শুষ্ক মৌসুমে সুরমা হয়ে পড়ে বালুভূমি। অন্যদিকে অল্প বৃষ্টিতেই নদী উপচে নদী তীরবর্তী এলাকায় দেখা দেয় বন্যা। বৃষ্টিতে নদীর পানি উপচে তলিয়ে যায় হাওরের ফসল।


শুধু কি ভরাট হয়েছে নদীপথ? সুরমার উৎসমুখও ভরাট হয়ে গেছে।


শিলচরের গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুমে বর্তমানে নদীর উৎসমুখের ৩২ কিলোমিটারে জেগে উঠে ৩৫টি চর। দুই দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় যৌথ নদী কমিশনে সিদ্ধান্ত না হওয়ায় আটকে আছে উৎসমুখ খননও।

সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, গত ২০১৮ সালে সিলেট সদর উপজেলার কানিশাইলে ৬০০ মিটার সুরমা নদী খনন করা হয়। ওই সময় সিলেট সদর উপজেলা এবং কানাইঘাট উপজেলার কয়েকটি অংশে নদী খননের জন্য প্রস্তাবনা পেশ করা হয়, তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এমন কি, সুরমাসহ এই এলাকার নদীগুলো খননের জন্য একটি প্রকল্প পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের তরফ থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তাও বছর দুই পার হয়ে গেছে। সূত্র জানায়, ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে এখন মন্ত্রণালয়ের বিবেচনাধীন।

কমছে পানি, বাড়ছে দুর্ভোগ

ধীর গতিতে নামছে  সিলেটে বন্যার পানি। এখন পর্যন্ত সাড়ে ৮ লাখ মানুষ পানিবন্দী। এখনো ৪ পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইছে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি ।


এদিকে, বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে পর্যাপ্ত ত্রাণের সংকট রয়েছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগিরা। একই সাথে বন্যার পানিতে তলিয়ে রয়েছে নলকূপ। ফলে আশ্রয়কেন্দ্রসহ বন্যা কবলিত এলাকায় রয়েছে বিশুদ্ধ পানির অভাব।


তবে জেলা প্রশাসনের পক্ষে বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিচ্ছে। তবে বানভাসীদের দাবি যা দেয়া হচ্ছে-তা চাহিদার তুলনায় কম।


সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্র রবিবার (২৩ জুন) দুপুরে জানায়, এ সময় পর্যন্ত সিলেটে ৮ লাখ ৫২ হাজার ৩৫৭ জন বন্যা কবলিত। এর মধ্যে মহানগরে ১৫ হাজার। বর্তমানে মহানগরের ৮টি ওয়ার্ডসহ জেলার ১০৭টি ইউনিয়নে বন্যার পানি রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন ১৯ হাজার ৭৩৮জন। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে। পৌঁছানো হচ্ছে বিশুদ্ধ  পানি ও ওষুধপত্র।


তিন দিন ধরে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সিলেট মহানগরেরও বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি নামছে। তবে অনেক নিচু এলাকার সড়ক ও বাসাবাড়ি থেকে পুরোপুরি পানি নামেনি এখনো। অন্যদিকে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় লোকালয় থেকে পানি কমে যাওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বসতবাড়িতে ফিরছেন বাসিন্দারা। তবে যারা বাড়ি ফিরেছেন তারা পোহাচ্ছেন নানা ভোগান্তি।

বন্যার্তরা জানিয়েছেন, পানি কমার সাথে সাথে দুর্ভোগও বাড়ছে বাসিন্দাদের। অনেক জায়গায় বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে। রান্না-বান্নায়ও কষ্ট হচ্ছে বন্যার্তনের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্যা কবলিত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে রয়েছে পর্যাপ্ত ত্রাণের অভাব। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে যেসব ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় কম। বিশুদ্ধ পানির সংকটও রয়েছে এলাকাগুলোতে। গবাদি পশুর খাবার নিয়েও বিপাকে রয়েছেন অনেকে।

টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে গত ২৭ মে  সিলেটে আগাম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে জেলার সব উপজেলার সাড়ে ৭ লাখ মানুষ আক্রান্ত হন। সেই বন্যার পানি পুরোপুরি নামার আগেই ১৫ জুন ফের কবলিত হয় সিলেট।

পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো সিলেট কার্যালয় সূত্র রবিবার বিকাল ৩টায় জানিয়েছে, এ সময় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ২২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। তবে এ নদীর  পানি সিলেট পয়েন্টে রয়েছে বিপৎসীমার নিচে। একই সময়ে কুশিয়ার নদীর পানি আমলশীদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪০, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৯৯ ও শেরপুর পয়েন্টে ৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।


এদিকে, সিলেটে গত দুদিন উল্লেখযোগ্য কোনো বৃষ্টিপাত হয়নি। তবে আগামী ২ দিন  সিলেট অঞ্চলের উপর দিয়ে দক্ষিণ/দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ঘণ্টায় ৪৫-৬০ কিলোমিটার বেগে অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।

বন্যার পানি ধীরে নামার কারণ হিসেবে পানি উন্নয়ন বোর্ড  সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন- ফেঞ্চুগঞ্জের উজানে রয়েছে জুড়ী নদী।  এছাড়া মনু নদীও কুশিয়ারার শেরপুরে এসে যুক্ত হয়েছে। ফলে কুশিয়ারা নদীর পানি নামছে ধীর গতিতে। তাছাড়া ডাউন-স্ট্রিম এর প্রায় সব এলাকা প্লাবিত। এটাও বন্যার পানি ধীর গতিতে নামার একটি কারণ। তবে বৃষ্টিপাত না হলে ও সিলেট অঞ্চলে প্রতিদিন রোদ হলে বন্যার পানি কমা অব্যাহত থাকবে।


সিলেট জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান জানান, সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হয়েছে। বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়গুলোতে স্থাপিত কন্ট্রোল রুমে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া প্রতিটি উপজেলায় ডেডিকেটেড অফিসার নিয়োগের পাশাপাশি প্রতিটি ইউনিয়নে ট্যাগ অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে। বন্যার্তদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ইউনিয়নভিত্তিক মেডিকেল টিম গঠন করে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। তবে আগামী ২৮ জুন থেকে সিলেট অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে।

মন্তব্য করুন